নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হলো
সংবিধানে ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকার
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তিত হয় ১৯৯৬ সালে, মূলত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এ ব্যবস্থায় পর পর চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তা সত্ত্বেও ২০১১ সালের ১০ মে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানটি বাতিলের রায় ঘোষণা করেন। সেই মাফিক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়। এর ফলে নির্বাচনব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পর পর তিনটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম হয়। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষ নতুন করে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছে। এ প্রেক্ষাপটে গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এ রায়ে ১৪ বছর আগে দেওয়া ২০১১ সালের রায় বাতিল হলো, আবার ফিরে এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
আদালতের সাম্প্রতিক রায়ের যুক্তি- সংবিধানের সেই রায় ছিল ত্রুটিপূর্ণ, এমনকি বিচারকদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল- দেশের গণতন্ত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে একটি নতুন আস্থার সূচনা ঘটিয়েছে। মূল আদালতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়টা মূলত পক্ষপাতমূলক ছিল। যে রায়ের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হলো।
রায়ের অব্যবহিত পরই বিভিন্ন মহল থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে। অ্যাটর্নি জেনারেল মন্তব্য করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ায় গণতন্ত্র ফের ‘মহাসড়কে’ ফিরল। সুজনসহ আপিলকারী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও বলেন, এই রায় নির্বাচনকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনবে। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরা মনে করেন, বাতিল হওয়া ব্যবস্থা আবার ফিরে আসায় রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একদিকে এটি জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন, অন্যদিকে একটি সাহসী বিচারিক সিদ্ধান্ত- যা নির্দেশ করে, গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে আদালত তার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। তবে এখানেই শেষ নয়। তাই আপিল বিভাগের এই রায় কেবল একটি আইনগত মোড় ফেরানো নয়- এটি রাজনৈতিক আস্থাবোধ পুনর্গঠনের সূচনা। অতীতের বিতর্ক, অবিশ্বাস ও বিভক্তিকে পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর সুযোগ এটি। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর পরিণত আচরণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি জনগণের মতামতের প্রতি সম্মান।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্র বহুবার সংকটে পড়েছে, কিন্তু প্রতিবারই জনগণ পথ খুঁজে নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার এই পুনরুজ্জীবন সেই দীর্ঘ পথচলার আরেক ধাপ- যেখানে ভোটাধিকার, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা এবং শাসনে জনগণের আস্থা আগামী দিনের রাজনীতিকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে। এখন অপেক্ষা- এই সুযোগ কীভাবে জাতীয় ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নের শক্ত ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ নির্বাচন হওয়ার পর চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োগ হতে পারে। তবে ত্রয়োদশ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তা সঙ্গতভাবেই জনগণের প্রত্যাশা, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার দলনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রেখেই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করবে। বলা আবশ্যক যে, দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি, তবে শেষ কথা নয়। একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি