ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স
প্রতিবছর ১৮-২৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহ পালন করা হয়। এবারও পালন করা হয়েছে। যার স্লোগান ‘অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন হই, সকলে মিলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করি।’ বাংলাদেশে প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সপ্তাহ পালন করা হয়। যে কোনো মহামারী একদিন শেষ হয় কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস (অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক) ওষুধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী আরও এক কঠিন এবং মর্মান্তিক সময়ের মুখোমুখি হবে! হয়তো এমন দিন খুব কাছেই যেদিন হাতে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস থাকা সত্ত্বেও অনেক মুমূর্ষু রোগীকে আমরা চিকিৎসাই দিতে পারব না! কারণ যে জীবাণু দিয়ে সে আক্রান্ত তা সব ধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী!!
জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের কোনো বিকল্প নেই। ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু দিয়ে যে ইনফেকশনই হোক না কেন, তার প্রতিকারে এসব ওষুধ কার্যকর। তবে বিনা প্রয়োজনে, ওষুধের ডোজ বা কোর্স সম্পূর্ণ না করে এসব ওষুধ ব্যবহার করলে তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি করে। পরে এসব অ্যান্টিমাইকোবিয়ালস ওষুধ জীবাণুর বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারে না। তাই জীবন বাঁচাতে হলে এসব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ব্যবহারে সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে হবে এবং নিয়ম মেনে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এসব ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী সাত লাখ মানুষ মারা যায় এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্সের কারণে।
যেসব জীবাণু একাধিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস বা অণুজীববিরোধী ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তাদের গউজ (গঁষঃরফৎঁম ৎবংরংঃধহঃ) বলা হয়। আবার যেসব জীবাণু ব্যাপকভাবে ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধী তাদের ঢউজ (ঊীঃবহংরাবষু ফৎঁম ৎবংরংঃধহঃ) এবং এরা যখন সম্পূর্ণভাবে ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন এসব জীবাণুকে চউজ (চধহ ফৎঁম ৎবংরংঃধহঃ) বলা হয়। সব ধরনের অণুজীবই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে আমাদের সবারই ভূমিকা রয়েছে :
* শুধু রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ক্রয় ও সেবনের মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্সের হার কমানো সম্ভব।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
* প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা যেমন ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমনি যারা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ব্যবহার করছেন তারাও সঠিক নিয়মে এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারেন।
* অযথা, ভুল অথবা নিয়ম না মেনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ব্যবহার শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বিরাট ক্ষতির কারণ। তাই নিজেদের স্বার্থেই ওষুধের এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
* সরাসরি ওষুধের দোকান, হাতুড়ে ডাক্তার ও অন্য কোনো রোগীর প্রেসক্রিপশন মোতাবেক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ক্রয় বা সেবন একেবারেই কাম্য নয়।
* মাছ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামারে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করা অতীব জরুরি। কারণ এসব খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমরাও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলে, বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয় তার অর্ধেকই ব্যবহার করা হয় গবাদিপশু উৎপাদনে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
* অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রতিরোধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছাড়াও চিকিৎসক, ওষুধ ক্রেতা-বিক্রেতা, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও যুব প্রতিনিধির অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক স্টুডিও সংলাপ বা আলাপচারিতা অনুষ্ঠান প্রতিনিয়ত ফেসবুক পেজে, ইউটিউব, অনলাইন পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করতে হবে।
* যেসব রোগী বাড়িতে এ ধরনের ওষুধ নিয়মিত বা দীর্ঘদিন সেবন করেন তাদের এ ধরনের ওষুধ গ্রহণের বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও সচেতনতা থাকা জরুরি। রোগী এবং রোগীর স্বজনদের রোগী পরিচর্যার মাঝে সঠিকভাবে জীবাণুনাশকের ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং রোগীর কাপড় ও পরিবেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা এ ধরনের প্রতিরোধ তৈরি বা রেজিস্ট্যান্স ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
* উন্নয়নশীল দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের সহজলভ্যতার কারণে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্সের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে দেশের সরকারপ্রধানদের কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং পাশাপাশি আইন অমান্যকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
* আমাদের সবার যথোপযুক্ত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের ব্যবহারই আমাদের সন্তানদের এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে রেজিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী জীবাণুদের মরণঘাতী সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
ডা. কাকলী হালদার : সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ