সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?

দুবাই আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন

ড. মনজুরুল হান্নান খান
২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?

এবার আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনের ২৮তম আসর বসবে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাই শহরে। সম্মেলন শুরু হবে নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে আর শেষ হবে ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩। যেসব রাষ্ট্র জাতিসংঘের জলবায়ু কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে প্রতিবছর এই সদস্য রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ। প্রথম কপ হয়েছিল ১৯৯৫-এ জার্মানির বার্লিন শহরে। এবার দুবাই শহরে হবে ২৮তম কপ।

জল যেমন গড়িয়ে যায়, বায়ু যেমন উড়তে উড়তে চলে যায়, তেমনি একে একে ২৭টি কপ শেষ হয়েছে। যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন এতদিনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য অগ্রগতি হয়েছে কতটুকু। এই প্রশ্ন আমাদের সবার। আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন থেকে প্রতিবছর পুরনো কথায় নতুন সুরের নতুন গানে আমরা আশান্বিত হই। এবার বুঝি সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে। আমরা কপের সিদ্ধান্ত সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়ন দেখতে পাব। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশের মতো চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একান্তভাবে পাওয়া যাবে। কিন্তু তা বাস্তবে হয় না। এ যেন এক ছোটগল্প। শেষ হয়েও হয় না তার শেষ। আবারও আলোচনার জন্য পরবর্তী কপের স্থান এবং তারিখ নির্ধারণ করা হয়। মন ভোলানো গল্পের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো পরবর্তী কপের জন্য অপেক্ষায় থাকে।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য হলো সমগ্র বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা। যাতে করে পৃথিবীর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি না পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিস্তার রোধে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছিল যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেন কোনোভাবেই এই শতাব্দী শেষে গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির বেশি বৃদ্ধি না পায়। সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমানো সম্ভব না হলে জলবায়ু পরিবর্তন হবে, ফলে সমগ্র বিশ্বে নেমে আসবে অসহনীয় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষার একমাত্র সমাধান বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। আর তা করতে হলে আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বকে এই বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাপক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। এ বিষয়ে নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্বের ঐতিহাসিকভাবে দায় রয়েছে। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের ফলে মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করেছে। যে কারণে আজ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো সম্ভব না হলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকবে।

জলবায়ু কনভেনশনে এবং কপের মাধ্যমে আরও যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণ, উন্নত বিশ্ব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, কারিগরি জ্ঞান ও সক্ষমতা প্রদান করা। এসব বিষয়ের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রবল দাবির মুখে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংগঠিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লস এবং ডেমেজের জন্য আলাদা একটি তহবিল গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অবিলম্বে আর্থিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা।

এই প্রেক্ষাপটে কপ২৮-এ যেসব বিষয়ে আলোচনা হবে তার ওপর বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। তা না হলে এই কপ২৮ থেকেও কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাবে না। কপ২৮-এর প্রেসিডেন্ট ড. সুলতান আল জাবের Global Cooling Pledge-এ অংশগ্রহণের জন্য উন্নত বিশ্বকে আহ্বান জানিয়েছেন। উন্নত বিশ্ব যেন তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি অর্জনে সহায়ক হয়। অর্থাৎ বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানোর জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেই অগণিত মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দেখা যাক কপ প্রেসিডেন্টের আহ্বানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের অঙ্গীকার কতটুকু ফলপ্রসূ হয়।

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব জাতীয়ভাবে যে অঙ্গীকার করেছে তা কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে তার হিসাব নেওয়া খুব জরুরি। উন্নত বিশ্ব গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য অঙ্গীকার করলেও বাস্তবায়ন চিত্র ভিন্নকথা বলে এবং এর সঠিক হিসাব পাওয়াও দুষ্কর। তাই এই কপে উন্নত বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর স্বচ্ছ হিসাব পাওয়া দরকার। দেখা দরকার অঙ্গীকার অনুযায়ী কী পরিমাণ নিঃসরণ তারা কমাতে পেরেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে তাদের হিসাব। তাদের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ আদৌ ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কিনা।

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমানোর উদ্যোগকে সবাই মিলে বাস্তবায়ন করা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। কিন্তু কথা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যেই যেসব দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দলবদ্ধভাবে negotiation করতে হবে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব থেকে অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার সফল বাস্তবায়ন, উন্নত বিশ্ব থেকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে ২০০০ সাল থেকে প্রতিশ্রুত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান, লস এবং ডেমেজের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, কারিগরি জ্ঞান ও সক্ষমতা প্রদানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ। দুবাই আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন বা কপ২৮ সফলতা জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আমরা একান্তভাবে এই কপের সফলতা কামনা করি। কপ২৮ সফল হোক এই প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম।


ড. মনজুরুল হান্নান খান : জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ 

এবং

নির্বাহী পরিচালক

ন্যাচার কনভেনশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)