বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার

নূর কামরুন নাহার
২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার

সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। ১৫ থেকে ৫৯ বছর বা ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর কোনো প্রতিফলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।

গত মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮, যা ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। এই বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। তবে একই সঙ্গে উদ্বেগজনক বিষয় হলো শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণের হার ২০১০ সাল থেকেই নিম্নমুখী। ২০১০ সালে শহরে শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ নারী, ২০২২ সালে এই অংশগ্রহণের হার ২৩ দশমিক ৬-এ এসে ঠেকেছে। একই সময়ে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ দশমিক ৮৯-তে।

শহরে তথা বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমানই হয়ে উঠেছিল তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে। টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সকালে শহরের পথে মিছিলের মতো চলছে নারী এটাই ছিল শহরের রাস্তার স্থিরচিত্র। গত কয়েক দশকে এ খাতে নারীশ্রম এবং দেশের অর্থনীতিতে তার অবদানও বহুল আলোচিত বিষয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গত দশক থেকে এ খাতেও নারী শ্রমিকদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট’-এর অধীন পরিচালিত ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তৈরি পোশাকশিল্পে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের হার যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ৫ এবং ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ; যেখানে ২০১২ সালের দিকেও এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই ছিলেন নারী।

সস্তা ও সহজলভ্য শ্রমই ছিল তৈরি পোশাকশিল্পে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের মূল কারণ। বর্তমানে এই খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, লেগেছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের হাওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে নারীরা পিছিয়ে থাকার কারণেই এই খাত থেকে ঝরে পড়ছে নারী শ্রমিক।

নারীর জন্য নির্ধারিত পেশার অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক, খণ্ডকালীন ও অনিয়মিত প্রকৃতির। যার মধ্যে রয়েছে নার্স, বিউটি পার্লারকর্মী, গৃহকর্মী, গৃহভিত্তিক দর্জি ও গৃহভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইত্যাদি। এসব খাতে সুযোগ সীমিত এবং কাজ হারানোর ঝুঁকিও সর্বোচ্চ।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমার গত ১৫ মে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নের সঙ্গে এখানকার নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অঞ্চলের নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। তারা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন, আবার যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ, সম্পদের মালিকানা এসব ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি মেলানো যায় না।’

বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক। একই কথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় অনানুষ্ঠানিক খাত গত কয়েক বছরে ছোট তো হয়ইনি, বরং আরও বড় হয়েছে। হ্যান্স এটাকেও উন্নয়নের পথে বড় বাধা বলে মনে করেন।

তার মতে, সমাজের গভীরে প্রোথিত রীতিনীতির কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ছেন, বিশেষ করে পরিবারের শ্রমের বিভাজন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

শ্রমবাজারে লিঙ্গভিত্তিক পেশাগত বিভাজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নারীদের ঘরের কাজ ও সন্তান পালনসহ পুনরুৎপাদনশীল কাজের ভার। নারীর দক্ষতা অর্জনে যা এক বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯-এর একটি প্রতিবেদন ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস’-এ উঠে এসেছে ‘বিয়ে’ শহরের নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। শহরের ছোট পরিবারে সন্তান লালন-পালনের গুরুভার প্রায় পুরোটাই নারীর, যা সামলে উৎপাদনমূলক কাজে জড়িত হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত। ফলে তারা ঝুঁকে পড়ে অনানুষ্ঠানিক ও খণ্ডকালীন কাজে।

২০১৯-এ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন ‘হোয়াট ওয়ার্কস ফর উইমেন’-এর মতে, ঢাকা শহরের জনপরিসর এবং পরিবহনব্যবস্থা নারীবান্ধব নয়। শহরে ব্যবহারোপযোগী শৌচাগার, মাতৃদুগ্ধ পানকেন্দ্র, নিরাপদ গণপরিবহনব্যবস্থা, ফুটপাত ইত্যাদির অভাব চরমভাবে পরিলক্ষিত।

শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণে করোনার ছোবলও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি প্যানেল জরিপে উঠে এসেছে, করোনার ঠিক আগে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) যেসব কর্মজীবী নারী কোনো আয়মূলক কাজের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ মে ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী কর্মহীন ছিলেন, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৪ শতাংশ। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী নারীদের একটি বড় অংশ শহরের নিম্নআয়ের শ্রমজীবী নারী।

কেন এসব নারী শ্রমবাজারে ফিরতে পারছেন না, তার কারণগুলো অনুসন্ধান করে বিআইজিডির গবেষক জাহিদ নূর দেখতে পেয়েছেন, জেন্ডারভিত্তিক অন্তরায়গুলো করোনাকালে আরও প্রকট হয়ে তাদের শ্রমবাজারে ফেরাকে প্রতিকূল করে তুলেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম ‘পুটিং উইমেন ইন দ্য সেন্টার অব অ্যাগ্রিকালচার’ শিরোনামে এক গবেষণাপত্রে বলেন, গত ২৫ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী মজুরি পান। এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়েছিল ‘জেন্ডার সমতাই শক্তি : নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন।’ বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, আমেরিকায়ও যে জেন্ডার সমতা নেই তা গ্লোডিনের গবেষণা আর নানা পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে। আর এই লৈঙ্গিক বৈষম্য রয়েছে বিশ^ব্যাপী। যত কথাই বলা হোক না কেন, নারীর জন্য শ্রমবাজার এখনো বৈষম্যপূর্ণ, শ্রম বিভাজনের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে শ্রমবাজার থেকে ঝরে পড়ে নারী, তার মজুরি হয় কম।

অর্থনীতিতে গোল্ডিনের নোবেল পুরস্কার প্রদানের উপসংহারে রয়াল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অর্থনৈতিক বিজ্ঞান কমিটির চেয়ারম্যান জ্যাকব সভেন্সন বলেছেন, ‘শ্রমবাজারে নারীর ভূমিকা বোঝা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

এক অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে তিনি বিশ^কে সজাগ করেছেন। শ্রমবাজারে নারীর ভূমিকা এবং এ বাজারে তার টিকে থাকার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বর্তমান উন্নয়ন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ট্যাবু ভেঙে নারী বের হয়ে আসছে, কিন্তু শ্রমবাজার জেন্ডার বৈষম্যহীন হচ্ছে না। যদি সত্যিই পৃথিবীতে জেন্ডার সমতা আনতে হয়, যদি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে জেন্ডারকে সংযুক্ত করতে হয় তা হলে শ্রমবাজারে নারীর ভূমিকা এবং নারীবান্ধব শ্রমবাজারের কথা ভাবতেই হবে, বেরিয়ে আসতে হবে লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজন থেকে। না হলে নারীর শ্রম ও মেধা কখনই পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাবে না, পরিপূর্ণ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থাকবে বিশ^।


নূর কামরুন নাহার : কবি ও কথাসাহিত্যিক