আতঙ্ক নয়, সচেতনতা কাম্য
বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত কম্পন আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রস্তুতি নেওয়া কতটা জরুরি। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব না হলেও প্রস্তুতি ও সচেতনতা ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমাতে পারে। তাই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি রোধে করণীয় পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সবার জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎ ঢাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যার মাত্রা ছিল ৫.৭। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি নরসিংদী জেলার মাধবদী উপজেলায়। এতে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা গেছে। বিশেষ করে রাজধানীর কলাবাগান, নিউমার্কেট, বংশাল ও বাড্ডায় বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা গেছে। দুই শিশুসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। অসংখ্য আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। ভূমিকম্পে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অতীতে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়েছে সিলেট জেলায়। পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে ভূমিকম্প হওয়ার অধিক আশঙ্কা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ভূমিকম্প মানবসমাজের জন্য এক অদৃশ্য আতঙ্ক। ক্ষণিকের এই কম্পন কখন কোথায় আঘাত হানবে, তার নির্ভুল পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভূমিকম্পের মূল কারণ ও এর প্রক্রিয়া নির্ধারণ করেছেন। ভূমিকম্প আসলে পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্ত হওয়ার ফলাফল।
টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া : পৃথিবীপৃষ্ঠ একটানা নয়; এটি নানা অংশে বিভক্ত বড় বড় কঠিন প্লেট দিয়ে তৈরি। এই টেকটোনিক প্লেটগুলো ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। দুটি প্লেট যখন একে অপরের দিকে ঠেলে আসে, সরে যায় বা ঘর্ষণ সৃষ্টি করে, তখন ভূগর্ভে প্রচণ্ড চাপ জমতে থাকে। কোনো এক সময় এই চাপ হঠাৎ মুক্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে। এভাবেই ঘটে ভূমিকম্প।
ফল্ট লাইনে শক্তি সঞ্চয় : ভূপৃষ্ঠের নিচে থাকা বড় ফাটল বা ফল্ট লাইন ভূমিকম্পের প্রধান কেন্দ্র। এসব ফাটলের দুই পাশের শিলাস্তর দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। একসময় সঞ্চিত শক্তি আর ধারণ করতে না পেরে ফল্ট লাইন বরাবর সরে যায় বা ভেঙে যায়, যার ফলেই সৃষ্টি হয় কম্পন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সাবডাকশন জোনের ধাক্কা : সমুদ্রীয় ভারী প্লেট যখন হালকা মহাদেশীয় প্লেটের নিচে ঢুকে যায়, তখন সঞ্চিত শক্তি আরও বেশি হয়। এ ধরনের অঞ্চলকে সাবডাকশন জোন বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলো এই অঞ্চলে উৎপন্ন হয়েছে।
আগ্নেয়গিরির প্রভাব : অগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে ম্যাগমা ও গ্যাসের চাপ বেড়ে গেলে মাটির নিচে ছোট-বড় কম্পন তৈরি হয়। আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের আগেও অনেক সময় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যাকে ভলকানিক ভূমিকম্প বলা হয়।
মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত ভূমিকম্প : খনি খনন, তেল-গ্যাস উত্তোলন, বড় বাঁধে পানির অতিরিক্ত চাপসহ কিছু মানবসৃষ্ট কার্যক্রমও অল্পমাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। যদিও এগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তবু পরিবেশ ও জনবসতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ভূমিকম্পের আগে করণীয় : প্রথমেই নিজের বাড়ি ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভবনের দুর্বল অংশ, বিশেষ করে খুঁটি, সিঁড়ি ও দেয়ালের ফাটল মেরামত করা উচিত। ভারী আলমারি, তাক, ফ্রিজসহ বড় আসবাব দেয়ালে শক্তভাবে আটকানোর পাশাপাশি জরুরি ব্যাগে টর্চ, পানি, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজ রাখা উচিত। পরিবার বা কর্মস্থলের সবার সঙ্গে জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা ও অনুশীলন করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ভূমিকম্পের সময় করণীয় : ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত নিরাপদে অবস্থান নেওয়াই মূল করণীয়। ঘরের ভেতরে থাকলে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত আসবাবের নিচে আশ্রয় নিয়ে মাথা ও ঘাড় সুরক্ষিত রাখতে হবে। জানালার কাছে যাওয়া ও লিফট ব্যবহার করা বিপজ্জনক। বাইরে থাকলে ভবন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা সাইনবোর্ড থেকে দূরে খোলা জায়গায় অবস্থান নিতে হবে। গাড়িতে থাকলে রাস্তার পাশে নিরাপদ স্থানে থামতে হবে, তবে ব্রিজ বা উঁচু ভবনের নিচে নয়।
ভূমিকম্পের পরে করণীয় : কম্পন থেমে গেলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বন্ধ করা উচিত। ভবনের ক্ষতি পরীক্ষা না করে ভেতরে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ। আহতদের দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে এবং জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করা সব নাগরিকের দায়িত্ব।
সর্বোপরি ভূমিকম্প প্রতিরোধের মূল শক্তি হলো সচেতনতা, প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীলতা। পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ- সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। আজই নিজের ও আশপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিলে আগামীর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মো. শরীফুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ