রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!

মহসীন হাবিব
২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!

আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে এখন ইসরায়েল ও হামাস যোদ্ধাদের নিয়ে লেখা ছাড়া আর কোনো কিছু মাথায় আসে না। আসার কথাও নয়। বিশ্বের কোথাও না কোথাও সব সময় একটি বার্নিং ইস্যু থাকে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা, অতঃপর ইসরায়েলের ব্যাপক প্রতিশোধমূলক হামলার আগে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। অন্যসব যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধও ভয়াবহ। এখনো তা অব্যাহত আছে। কিন্তু ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের তীব্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধ সংবাদের ফন্ট ছোট হয়ে পত্রিকার পাতার নিচের দিকে চলে গেছে। আমরা এখন দিন-রাত ইসরায়েল-হামাসের আপডেট নিয়ে থাকি।

এই যুদ্ধের অনেক বিস্ময়কর বিষয় এখনো রহস্যে ঘেরা। এই যুদ্ধ অন্য দশটি প্রচলিত যুদ্ধের মতো নয়। হামাস কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তি নয়। এটি একটি সংগঠন। হরকাত আল মুকাওয়ামাহ আল ইসলামিয়া নামক সংগঠনটিকেই সংক্ষেপে হামাস বলা হয়। এটি মূলত ফিলিস্তিনের গাজাভিত্তিক একটি সংগঠন। ফিলিস্তিন দুই অংশে বিভক্ত। একটি ওয়েস্ট ব্যাংক বা পশ্চিমতীর, অন্যটি গাজা। ২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে গাজা শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে হামাস। বরাবরই হামাসের বিশ্বাস, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধই হলো একমাত্র পথ।

কিন্তু গত ৭ অক্টোবরের আগে কেউ ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেননি, ওই প্রতিরোধ যুদ্ধের পরিণাম এমন ভয়াবহ হয়ে উঠবে। হামাস প্রায়ই ইসরায়েলে রকেট হামলা চালাত। ২০০১ সাল থেকে তারা এই রকেট হামলা শুরু করে। প্রথম দিকে যে রকেটগুলো হামাস তৈরি করত, সেগুলো ছিল একেবারে হাতে বানানো পটকার মতো। সার ও চিনির সঙ্গে পটাসিয়াম নাইট্রেট মিশিয়ে ওই রকেট বানানো হতো। এগুলোর দূরত্বও ছিল অতি কম- তিন-চার কিলোমিটার। সীমান্তের কাছাকাছি থেকে রকেট ছুড়ে দিতে হতো ইসরায়েলের ভূখণ্ডে। ওই রকেট অনেক সময় ছুড়তে গিয়েই বিস্ফোরিত হতো। হামাসের মিলিটারি উইং কাসাম ব্রিগেড ওই রকেট তৈরি ও ব্যবহার করত বলে এর নাম হয়েছিল কাসাম রকেট। পরে ইরানের সহায়তায় এই রকেট আধুনিক হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে একটি নল দিয়ে একটি রকেট ছোড়া যেত। যে লাউন্সিং প্যাড থেকে ছোড়া হতো, তা ধ্বংস হয়ে যেত। পরে একটি মেশিন থেকেই সাতটি নল দিয়ে সাতটি রকেট ছোড়ায় উন্নত করা হয়। প্রথম দিকের রকেটগুলো সীমান্ত পার হতো মাত্র। আধুনিক করার পরেরগুলো তেলআবিব পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম অর্জন করে।

এরা রকেট ছোড়ে, ওরাও টার্গেট করে এক বা দুইজন হামাস নেতাকে হত্যা করে- এভাবেই চলছিল। এই রকেট ঠেকাতে ইসরায়েল অত্যাধুনিক আয়রন ডোম নামক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। দেখা যেত, ইসরায়েল রকেটগুলো মিসাইল প্রতিরক্ষা সিস্টেমে ওই আয়রন ডোম দিয়ে প্রতিরোধ করে করত। হামাসের রকেট নিক্ষেপের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে গাজার সব যোদ্ধার কাছে। এবার হামাস এক ভয়ানক পরিকল্পনা করে। তারা রকেটের সংখ্যা দিয়ে ইসরায়েলকে কাবু করতে চেষ্টা করে। কারণ আয়রন ডোম কত ঠেকাবে? হামাস একই সঙ্গে ৫ হাজারের বেশি রকেট হামলা চালায় এবং প্রথম দিকে সফল হলেও এত রকেট হামলা ঠেকাতে আয়রন ডোম ব্যর্থ হয়। নার্ভাস হয়ে যাওয়া ইসরায়েলের ওপর একই সঙ্গে নৌপথ ও স্থলপথে কাঁটাতারের বেড়া বুলডোজার দিয়ে ভেঙে হামাস যোদ্ধারা ঢুকে পড়ে। এসব ঘটনা সবারই জানা। এর পরের টুকু সত্যিই রহস্যে আবৃত।

এই হামলার পরিকল্পনা নাকি হামাস দুই বছর ধরে করে আসছিল। ইসরায়েলের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বের অত্যন্ত দক্ষ সংস্থা বলে পরিচিত। একটি মোসাদ, আরেকটি শিন বেত। মোসাদ সাধারণত বিশ্বের অন্যান্য দেশে অপারেশন ও নজরদারিতে ব্যস্ত থাকে। আর শিন বেত হলো অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের কাজ গাজা, পশ্চিমতীর ও ইসরায়েলের ভেতরে সব খোঁজ রাখা। এ ছাড়া মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থা আমান অত্যন্ত তৎপর। এ তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার অসংখ্য সদস্য গাজা ও পশ্চিমতীরে কর্মরত। তারা কেউ বুঝতে পারল না যে, এমন একটি পরিকল্পনা করে হামাস এমন হাজারো রকেট তৈরি করছে? হামাস যেসব টানেল ব্যবহার করেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, তা তৈরি করতে আমাদের মেগা প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে। মাটির নিচে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা টানেলগুলো শুধু একটি গর্ত নয়, রীতিমতো কংক্রিট দিয়ে তৈরি এবং ভেতরে ইলেকট্রিসিটিও আছে। ৬০ থেকে ৮০ ফুট গভীরে এই টানেলগুলো তৈরি করতে হামাস শুধু যে যোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে, তা নয়; সাধারণ শ্রমিক ব্যবহার করা হয়েছে। এই শ্রমিকরা প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করার বিনিময়ে মাসিক ৩০০ ডলার মজুরি পেয়েছেন এবং জালের মতো বিছিয়ে এই টানেল তৈরি করা হয়েছে। এ রকম কিছু টানেল প্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধে তৈরি করেছিল ভিয়েত কং যোদ্ধারা। কথা হলো, ইসরায়েলের তিনটি অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা এর কিছুই জানতে পারল না! এমন গোছগাছ করা হামলা সম্পর্কে শত শত ইসরায়েলি গোয়েন্দা কিছুই জানতে পারল না!

দ্বিতীয় কথা হলো- এ প্রশ্নটি আগেও করেছি, কাঁটাতার ডিঙিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করা এবং ২৪০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। জানা গেছে, অতর্কিত এই হামলা কয়েক মিনিটের নয়, দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা চলেছে। ইসরায়েলের এত শক্তিশালী, বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স কোথায় ছিল? যে ইসরায়েল একা লড়াই করে একই সঙ্গে পাঁচটি শক্তিশালী আরব দেশকে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পরাজিত করেছে ১৯৬৭ সালে এবং আবার ১৯৭৩ সালে- ওই ইসরায়েল হামাসের মতো একটি সংগঠনের কাছে এভাবে নাস্তানাবুদ হবে, তা ভাবা যায়? দুষ্ট লোকরা কনস্পিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস রাখে। ওই থিওরি সর্বদা অসত্য নয়। একান্তই আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই হামলা সম্পর্কে ইসরায়েল সবকিছু জানত। তবে লোকবলের এত ক্ষতি হবে, সেটি বোধহয় বুঝতে পারেনি।

বিখ্যাত ‘মোসাদ’ গ্রন্থে উল্লেখিত প্রথম ঘটনাটি পড়লেই বোঝা যায়, ইসরায়েলের দ্বারাই এমন আক্রমণ করতে দেওয়া সম্ভব। লোক ক্ষয় হয়েছে বটে কিন্তু আগামীর হিসাব-নিকাশে বিশাল লাভ হয়েছে ইসরায়েলের। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘এভরি হামাস মেম্বার ইস ডেড’। অর্থাৎ তিনি সবার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যাবেন। তার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো সম্পূর্ণ একমত। আরব দেশগুলো কোনো পক্ষে নেই, একমাত্র ইরান। সত্যিকারে কত হাজার লোক মারা গেছে এখন পর্যন্ত, তা কেউ জানেন না। যা বলা হচ্ছে, সেটিই প্রচারমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। তাই ইসরায়েলের হাজার দেড়েক মানুষ বলির পাঁঠা হলো কিনা কে জানে! গাজা ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে, এমনকি পশ্চিমতীরের ঘরে ঘরে তল্লাশি চলছে। লেবানন, হুথি গোষ্ঠী ও ইরানের সম্পৃক্ততা অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা চলে না; অন্য লেখায় বলব।

এই যুদ্ধে ইসরায়েলেরও একটি ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত, ইসরায়েলের ডিফেন্স নিয়ে সারাবিশে^ যে একটি ধারণা ছিল- তা খাটো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চাপে পড়েছেন। এ যুদ্ধের অবসান হলে তাকে নেমে যেতে হবে- এটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে রাজনীতি ক্রিকেটের মতো অনিশ্চয়তার খেলা। তৃতীয়ত, আরব বিশে^র সঙ্গে অতিদ্রুত ইসরায়েলের যে সম্পর্ক গড়ে উঠছিল- তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটিই আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কিন্তু ইসরায়েলের হিসাব আছে। এই সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে আবার তৈরি করা যাবে। তবে আরব বিশ্বের সঙ্গে যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠছিল, এর মধ্যে হামাস তথা ফিলিস্তিন একটি কাঁটা হয়ে থাকত। আপাতত ওই কাঁটা দূর করা যদি ইসরায়েলের হিসাব হয়ে থাকে! সাদা চোখে দেখা যাবে না। ওই দিকটাতেও ভাবতে হবে। ইসরায়েল ও হামাসের সামরিক শক্তি, কৌশলগত শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি বাঘ এবং বিড়ালের শক্তির মতো পার্থক্য। এর পরও ইসরায়েল ‘যুদ্ধ করছে’- এই সহজ সমীকরণে গেলে তা হবে বিরাট বোকামি।


মহসীন হাবিব : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক