কর্মঘণ্টার প্রলোভনে নারীকে গৃহবন্দি করার ফাঁদ
বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক অবদান এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। কৃষি, মৎস্য, তৈরি পোশাকশিল্প, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ক্ষুদ্র বা মাঝারি উদ্যোক্তা সব ক্ষেত্রে নারীর শক্তিশালী উপস্থিতি বিদ্যমান। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু মানুষের এবং রাজনৈতিক বক্তব্যে নারীর স্পেস সংকুচিত করে ফেলা কিংবা নারীর স্বতঃস্ফূর্ততা বাধাগ্রস্ত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির সম্প্রতি এক বক্তব্যে জানান, ‘নারীরা ঘরে সময় দিলে সরকার তাদের সম্মানিত করবে এবং ক্ষমতায় এলে তার কর্মঘণ্টা কমিয়ে ৫ ঘণ্টা করা হবে।’ তার এই বক্তব্য নারীর প্রতি কেবল পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই স্মরণ করিয়ে দেয় না, বরং দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও অস্বীকার করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যিনি দেশ পরিচালনার নীতি তৈরি করতে চান, তিনি কি নারীদের কাছে একবার জানতে চেয়েছেন তারা কী চান? তারা কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি তুলেছিলেন কিনা তার কাছে? কিংবা নারীরা ঘরে সময় বেশি দিয়ে সম্মানিত হতে চান কিনা? সরকার যে তাদের সম্মানিত করবে- এমন সিদ্ধান্তে সরকার একমত হয়েছে কিনা? এছাড়া অফিসের পুরুষ সহকর্মীরা অসমান শ্রমে একই পরিমাণ মজুরি মানবেন কিনা? নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল কিনা? নির্বাচিত সরকার তখন এই সিদ্ধান্ত মানার দায় দেখাবেন কিনা? সব মিলিয়ে এটি মূলত জনতুষ্টিবাদী অবাস্তব রাজনৈতিক প্রচারণা এবং একই সঙ্গে নারীকে কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে ফেলার দীর্ঘমেয়াদি চতুরে এজেন্ডা।
নারীর শ্রমেই চলছে দেশের প্রধান খাতগুলো
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ২৮ লাখের বেশি- যাদের একটি বড় অংশ কাজ করেন উৎপাদন, রপ্তানি, কৃষি, সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, গৃহশ্রম কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এদের শ্রমশক্তি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে মোট শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০% নারী শ্রমিক। লেবার ফোর্স সার্ভের হিসাব বলছে, মোট নারী শ্রমশক্তির ৭৪% কৃষিতে নিয়োজিত এবং একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের প্রায় ৯৭% অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষিতে যুক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, মোট কর্মরত নারীদের ৯৬.৬% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে জড়িত। শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে যুক্ত আছেন- গৃহশ্রমিক, পার্লারকর্মী, রাঁধুনি, খাবার বিক্রেতা, ভাসমান হকার, ছোট দোকানদার, সেলাই কারিগর ইত্যাদি। শহরে নারীর শ্রমের সঙ্গে জড়িত যে বিপুলসংখ্যক মানুষ, পরিবার, অফিস কিংবা সেবা কাজে জড়িত- যাদের শ্রম না থাকলে শহরের জনজীবন থেমে যাবে। বন্ধ হবে অফিস, আদালত কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মঘণ্টা কমে গেলেও একই পরিস্থিতি তৈরি হবে। গ্রামীণ নারীর কৃষিসহ অন্যান্য খাতও নারীর শ্রম ছাড়া সম্পূর্ণ অচল। এত বড় শ্রমশক্তিকে ঘরে ফেরানোর প্রস্তাব তাই শুধু অদূরদর্শী নয়; এটি অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও বটে। এই বিপুলসংখ্যক নারীকে বাদ দিয়ে বা তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেশের অর্থনীতি কীভাব সচল রাখবেন তারা, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন! অন্যদিকে এসব শ্রমজীবী নারীর প্রত্যেকে একই সঙ্গে ভোটারও। এই বিপুল ভোটারের মতামত না নিয়ে জামায়াতের আমির এই একপেশে প্রস্তাব দেন কীভাবে- সেটাও বিরাট আশ্চর্যের বিষয়। নাকি তিনি নিজেকে নারীদের অধিকর্তা ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান?
ঘরের কাজ- অস্বীকৃত এবং মজুরিবিহীন শ্রম
পরিবার হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের একক। সেই পরিবারের প্রজনন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যাসহ সংসার ও আবাসকে গতিশীল রাখার মূল কাজটি করেন নারী, যিনি কন্যা, জায়া অথবা জননী; যা না করলে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাজকর্ম ও জীবনযাপন অসম্ভব হতো। নারীর এই নীরব অবদানের অর্থমূল্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা; যা মোট জিডিপির ৭৮.৮ শতাংশ। সিপিডির এক গবেষণায় এই চিত্র দেখা গেছে। একই গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে যে, প্রতিদিন একজন নারী গড়ে একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ সময় এমন কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। গবেষণামতে, একজন নারীর প্রতিদিন ১২ দশমিক ১টি কাজ জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে যার পরিমাণ ২ দশমিক ৭টি। গ্রাম ও শহরে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব একজন নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। অথচ গৃহস্থালির কাজে নারীর এই নীরব শ্রমের কোনো পারিশ্রমিক বা নগদ মূল্য না দেওয়ার কারণে নারীরা আজ সমাজে ও রাষ্ট্রে নানারকম বৈষম্যের শিকার। নারীর কারখানা, খামার বা অফিসের কাজকে শুধু জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মজুরিবিহীন শ্রম দেশের অর্থনীতিতে অদৃশ্য হলেও সমাজ টিকিয়ে রাখতে এটি অপরিহার্য। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, মজুরিবিহীন অদৃশ্য শ্রমে নারীরা ৩ গুণ বেশি সময় দেন। নারীদের ঘরে সময় দিলে সম্মান দেওয়ার প্রলোভন মূলত নারীদের মজুরিবিহীন শ্রমে আরও বেশি সম্পৃক্ত করার ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। বিপরীতে বরং পুরুষরা গৃহশ্রমে আরও বেশি সময় কীভাবে দেবেন সেই নির্দেশনা দরকার ছিল। মজুরিবিহীন শ্রম বলে পুরুষদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই- যেখানে গৃহ নারী-পুরুষ উভয়ের।
সম্মান নাকি আরও বেশি বৈষম্য
জামায়াতের আমিরের প্রস্তাব অনুযায়ী, অফিসে নারীদের ৮ ঘণ্টার বদলে ৫ ঘণ্টা কাজ করানো হবে, আর তিন ঘণ্টার ক্ষতিপূরণ সরকার দেবে। মুখে এটি সুবিধা মনে হলেও বাস্তবে এটি একটি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ফাঁদ। প্রথমত, কোনো নারী যদি সরকারি চাকরিজীবী হন, তবে সরকার কি নিজেকেই ভর্তুকি দেবে? দ্বিতীয়ত, প্রমোশন বা পদোন্নতি কোথায় যাবে? পুরুষ ৮ ঘণ্টা কাজ করছে, নারী ৫ ঘণ্টা- তাহলে একই প্রতিযোগিতায় নারীরা কীভাবে টিকে থাকবে? পদোন্নতির সময় কাকে আগে বিবেচনা করা হবে? তৃতীয়ত, কর্মঘণ্টা কমিয়ে নারীর কর্মজীবনকে সীমিত করা মানে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে নারীদের দূরে সরিয়ে রাখা। সর্বোপরি যে কোনো অফিসে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় পুরুষকে আগে বিবেচনা করবে- যা কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এখনকার অর্থনৈতিক বাস্তবতা
নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে অনেক আগেই। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় খাতেই নারীর অংশগ্রহণ মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেটা পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান শুধু দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে তা নয়। বরং একই সঙ্গে তার আয়ের অংশে পরিবারে সচ্ছলতা, পরিবারের অপরাপর সদস্যের ভরণ-পোষণ, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখাশোনা, নারীর নিজেকে আত্মনির্ভরশীল এবং আর্থিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। অন্যদিকে একজন কর্মজীবী মায়ের সন্তান বরং দ্রুত আত্মনির্ভরশীল, সংবেদনশীল, সচেতন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েও বেড়ে ওঠে। তারা শৈশব থেকে দায়িত্বশীল, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সংসারের কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক নারী অর্থনীতি থেকে বাদ পড়ে গেলে বা শ্রমঘণ্টা কমে গেলে অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে- একটা দেশের পক্ষে তা হুট করে সামাল দেয়াও কঠিন হবে। বিপরীতে অর্থনীতিতে একটা হযবরল অবস্থা তৈরি হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব কোথায়
নারীকে ঘরে রেখে সম্মান দেওয়ার যে ধারণা, তা আজ বহু মুসলিম সমাজেও বাতিল হয়ে গেছে। এমন একটি ধারণা আজকের বাংলাদেশের নারীরা বা ভোটাররা কতটা গ্রহণ করবেন- তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নারীদের অর্থনৈতিক খাতে অংশগ্রহণ বাড়ানোর চিন্তা বরং মৌলিক। নারীর উন্নয়ন তথা দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য বরং মনোযোগ দেওয়া দরকার নারীর সাংসারিক ভার কমানো এবং একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্র থেকে নারী যাতে ছিটকে পড়তে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা। সেজন্য অনেক বেশি আলোচনা করা উচিত মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাস্তবায়নে বাধ্য করা, যৌন হয়রানিমুক্ত নিরাপদ কর্মস্থল, মজুরি বৈষম্য কমানো, কর্মস্থলে এবং সরকারিভাবে পাড়ায় পাড়ায় ডে-কেয়ার তৈরি (অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারীদের জন্য), নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ নিরসনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। নারীরা ঘরে বসে থেকে শুধু সম্মান পেতে চায় না। সে চায় তার অর্থনৈতিক মুক্তি, কাজ করার স্বাধীনতা, ন্যায্য মজুরি, সম্মানজনক জীবিকা- কারও দয়াদাক্ষিণ্য নয়। নারীকে তার কাজ করার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না করাই হবে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন; সমশ্রমে সমমজুরি প্রদান করার মাধ্যমে তার মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠিত হবে- শ্রমঘণ্টা কমিয়ে নয়।
ফেরদৌস আরা রুমী : লেখক ও অধিকারকর্মী
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
মতামত লেখকের নিজস্ব