বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় লাফার্জহোলসিমের জিওসাইকেল প্রযুক্তি
বি শ^ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, ইউরোপ বা উন্নত দেশগুলোয় একজন বছরে গড়ে একশ কেজির বেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে সেখানে এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৬ কেজির মতো প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল মাত্র ৭ কেজি করে। বহুগুণে ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে মাটি, পানি ও নদীতে। শুধু প্লাস্টিক নয়; চামড়া, গার্মেন্ট ঝুটসহ অপচনশীল নানা ধরনের বর্জ্য এখন দেশের একটি বড় সমস্যা।
দেশের প্রধানতম শহরগুলো নদী বেষ্টিত। সেখানে বর্জ্যরে কারণে পুরো জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ^ব্যাংকের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ২৩ ফুট প্লাস্টিক বর্জ্য রয়েছে। ভালো নেই দেশের অন্য নদীগুলোও; বিশেষ করে বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানী শহরের আশপাশের তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ^রী এখন মৃতপ্রায়। এ ছাড়া সিলেটের সুরমা নদী, রাজশাহীর পদ্মা নদী, যশোরের ভৈরব নদ, কুমিল্লার মরা গোমতী নদীসহ বড় বড় শহরের পাশের নদ-নদী এখন দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। এই নদ-নদীর দূষণের অন্যতম বড় কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য। জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘দেশের নদীদূষণের ফলে সারাদেশে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
জলবায়ু সংকটে এ দেশ যখন বিপন্ন, তখন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের হাতে টেকসই কোনো উপায় নেই। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করায় জলবায়ু সংকটে আমরা এখন মহাবিপন্নের দ্বারপ্রান্তে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
উন্নত দেশগুলোয় টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অত্যাধুনিক অনেক প্লান্ট স্থাপন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এমন সর্বাধুনিক টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্টের কথা জানালেন লাফার্জহোলসিমের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার আসিফ ভূইয়া। তিনি বলেন, ‘পুরো পৃথিবীর ৮ শতাংশ উষ্ণতার জন্য সিমেন্ট সেক্টর দায়ী। তাই আমরা বিশ^ব্যাপী এই উষ্ণতা কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা একটি প্লান্ট স্থাপন করেছি- যেখানে টেকসই উপায়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পবর্জ্যসহ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্লাস্টিক, পলিথিন, চামড়া কো-প্রসেস করা হচ্ছে।’
ওই প্লান্ট সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে খোঁজখবর নিলাম। কোম্পানিটির ছাতক ফ্যাক্টরিতে বসানো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সব সুবিধার এই প্লান্টের নাম ‘জিওসাইকেল’। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কয়েক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ওই কোম্পানিটির ছাতক প্লান্টে যাই। জানলাম বর্তমানে দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ সিমেন্ট তৈরির কারখানা এটি। সাধারণত সিমেন্ট তৈরির মূল কাঁচামাল ক্লিংকার বিদেশ থেকে আমদানি করে সিমেন্ট উৎপাদন করা হয়। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ক্রসবর্ডার কনভেয়র বেল্টের মাধ্যমে ভারত থেকে চুনাপাথর নিয়ে আসা হয়। এই চুনাপাথরের সঙ্গে বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে আমদানি বিকল্প পণ্য ক্লিংকার তৈরি করা হয়। আর ক্লিংকার তৈরিতে প্রয়োজন প্রায় ১ হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।
লাফার্জহোলসিমের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অত্যাধুনিক ও টেকসই পদ্ধতিটি মূলত এ তাপমাত্রার কারণেই সম্ভব। এই তাপমাত্রার ফলে বিশেষ ব্যবস্থায় জিওসাইকেল প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য কো-প্রসেস করছে কোম্পানিটি। আর তাপমাত্রা পৃথিবীর ওপর অংশের কোনো প্রভাব ফেলছে না। অর্থাৎ প্লান্টের বাইরে এই উচ্চতাপমাত্রার কোনো প্রভাব নেই।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মূলত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা ধরনের বর্জ্য- যেগুলোর কোনো রিসাইকেল ভ্যালু নেই, তা এ জিওসাইকেল প্লান্টে আসছে। অর্থাৎ যেসব বর্জ্য ব্যবহার করে পুনরায় কোনো পণ্য উৎপাদন করা যায় না এবং যা শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে, তেমন বর্জ্য। বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য এখানে আনলোড করে শ্রেডিং মেশিনে প্রি-প্রসেস করে ১৬০ মিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে চলে যায় যেখানে ১ হাজার ৪০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ক্লিংকার বানানো হয়, সেখানে। ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব বর্জ্য আর পরিবেশে ফেরত আসে না। শুধু কিছু জলীয় বাষ্প চিমনি দিয়ে বের হয়। এই জলীয় বাষ্প জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর নয় বলেও পরিবেশবিদরা আমাদের জানিয়েছেন।
বিশেষ ওই সুবিধাটি স্থাপন করতে কোম্পানিটি প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। প্রতিবছর এই প্লান্টের মাধ্যমে ১ লাখ টন বর্জ্য কো-প্রসেস করা সম্ভব। গত বছর জিওসাইকেলের মাধ্যমে ৩৫ হাজার টনের বেশি বর্জ্য কো-প্রসেস করা হয়েছে। ভবিষ্যতের লক্ষ্য আরও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ববোধ।
এখানে এসে আরেকটি বিষয় অনুধাবন করলাম। সেটি হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। একটি বর্জ্যশূন্য সমাজ তৈরিতে কাজ শুরু করতে হবে ঘর থেকেই। অপচনশীল পণ্যগুলো শুরুতেই আলাদা করা গেলে মারাত্মক বিপর্যয় থেকে পরিবেশ রক্ষা পাবে। এর পাশাপাশি দরকার নীতিমালা; এমন একটি নীতিমালা- যাতে বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই সমাধানে বাধ্য ও আগ্রহী হয়।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
শাখাওয়াত উল্লাহ : পরিবেশ উন্নয়নকর্মী