মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও তাদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন অধিকার ও উচ্চ শ্রমমান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতির ঘোষণায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারক, বিশেষ করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে নতুন করে দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, কোনো কারণে শ্রম অধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করলে দেশের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। ঘোষিত নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শঙ্কা প্রকাশ করে বাণিজ্য সচিবকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এই নীতি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে। বিজ্ঞজনের মতে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানাবিধ অবাঞ্ছিত-অপাঙক্তেয়-অবান্তর বিষয়ে অহেতুক মানবাধিকার লঙ্ঘনের তকমা লাগিয়ে বশীভূত করার জুজুর ভয় অধিকমাত্রায় সঞ্চারিত। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক উপায়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয়গুলোর তথাকথিত নিষেধাজ্ঞা-পর্যবেক্ষণ জনগণকে অধিকারবঞ্চিত করার কুৎসিত ভিত রচনা করছে। নির্বাচনকে একপেশে চিন্তা-চেতনার দিকে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাণিজ্য নিষাধাজ্ঞার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবেই কল্পনা আক্তার নামে বাংলাদেশি শ্রমিক নেতার উদাহরণ টেনে বক্তব্য প্রদান কতটুকু মানবিক তার তাৎপর্যও উপলব্ধিতে আনা উচিত।
এটি সহজেই অনুমেয় যে, দেশবিধ্বংসী স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত অন্ধকারের শক্তির যোগসাজশে নির্বাচন বানচাল বা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় অন্তরায় সৃষ্টিতে কতিপয় কর্তৃত্ববাদী দেশের অপকর্ম থেমে নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কদর্য পরাশক্তির অযাচিত মন্তব্য-হস্তক্ষেপ দেশবাসীকে যারপরনাই মর্মাহত করে চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে বলেও অভিযোগ রাশিয়া ও চীনের। যুক্তরাষ্ট্রের মতের বিপরীতে গিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কঠোর হবে, তা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। কারণ আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন্স বিশ্বের সব দেশে শ্রম অধিকার নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে। এ ছাড়া শ্রম অধিকারের বিষয়টি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
উল্লেখ্য, মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘যারা শ্রমিকদের হুমকি-ধমকি দেবে, ভয় দেখাবে, শ্রম ইউনিয়নের নেতা-শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করা ব্যক্তি এবং শ্রম সংগঠনের ওপর আক্রমণ করবে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানান, শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের শ্রমমান উন্নয়নের জন্য কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির কেন্দ্রীয় এবং এটি পররাষ্ট্র দপ্তরের কার্যক্রমেরও মূল বিষয়। এটা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; শ্রম অধিকার আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতির চাবিকাঠি। আন্তর্জাতিক মানের শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সরকার-শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠন-বেসরকারি খাত এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে কাজ করবে। পৃথিবীর সব দেশে নিয়োজিত আমাদের রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসে কর্মরত ব্যক্তিরা শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে, যাতে করে আমাদের কাজের মধ্যে তাদের আওয়াজ প্রতিফলিত হয়।’ এ ছাড়া যারা শ্রমিক নেতা, শ্রমিক সংগঠন ও শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের ভয় দেখায় এবং তাদের ওপর আক্রমণ করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলে জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ইতোমধ্যে একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে পণ্য না নেওয়া কিংবা অর্থ পরিশোধ না করার শর্ত যুক্ত করে তৈরি পোশাকের ঋণপত্র দেওয়ার সংবাদে উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো ঋণপত্রের সাধারণ শর্তের মধ্যে বলেছে, বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে তারা পণ্য নেবে না। যদি পণ্য জাহাজীকরণের পরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো ঘটনা ঘটে, তা হলেও অর্থ দেবে না ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন শর্ত দেওয়ায় অনেক ব্যাংক মূল ঋণপত্রের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র নাও খুলতে পারে। এতে তৈরি পোশাক রপ্তানির পর অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিতে কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়। আবার ক্রেতা পণ্য না নিলে স্টক হয়ে যেতে পারে। তবে ব্যবসায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি বিশ্বের সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য সেহেতু অন্য দেশে ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের শর্ত হয়তো দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।’
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১১ ডিসেম্বর ২০২৩ সমসাময়িক শ্রম ইস্যু ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে শ্রম-বাণিজ্য বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতারা জানান, মার্কিন শ্রমনীতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) নবায়ন না করার উদ্বেগে দেশের ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত নন। শ্রম বিষয়ে বর্তমানে আমরা অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। আমাদের দুই হাজার ৫০০ কারখানার মধ্যে এক হাজার ৩০০-এর বেশি কারখানায় ইউনিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রম পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়নি, যে জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। বরং নিষেধাজ্ঞা এলে সেটি হবে রাজনৈতিক কারণে, শ্রমিক ইস্যুতে নয়। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, ‘আমরা কোনো নিষেধাজ্ঞায় ভীত নই। কারণ আমরা এমন কিছুই করিনি যেসব কারণে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। আইএলও কনভেনশনের ১০টির মধ্যে আটটি পূরণ করেছি। শ্রম ইস্যুতে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে। এর পরও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিলে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দায়িত্ববান শ্রমিক সংগঠন বা নেতা হলে তিনি কারখানার ক্ষতি করতে পারেন না। অনেক পক্ষ আছে যারা দেশের বিরুদ্ধে কথা বলে। ট্রেড ইউনিয়ন নিয়েও ভয় কাজ করে মালিকপক্ষের মধ্যে। ট্রেড ইউনিয়ন মানেই যখন-তখন কাজ বন্ধ করে দেবে সে ধরনের ইউনিয়ন নিয়ে আমরা ভীত।’
মজার বিষয় হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও শ্রম অধিকার ইস্যুসহ বেশকিছু ঘটনায় পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে একমত হতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেগ পেতে হচ্ছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যে ভাষায় বিবৃতি দিতে চাইছে, অন্য দেশগুলো তাতে রাজি হচ্ছে না। এমনকি বিবৃতির ভাষা পরিবর্তনে শর্ত আসছে এবং ঐকমত্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে। শেষ পর্যন্ত নমনীয় ভাষায় বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে, বাংলাদেশ নিয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও জাপানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি-কৌশলগত লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার থাকায় বাংলাদেশে নির্বাচন এবং শ্রম অধিকার ইস্যুতে তাদের পাশে পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বৈশ্বিক নানা বিষয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই রয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের পথেই হাঁটবে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা এক কূটনীতিক গণমাধ্যমকে জানান, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নেয়। আর আমাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। অগ্রাধিকার যদি মেলে কেবল তখনই সিদ্ধান্ত এক রকম হতে পারে। প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা কেবল আহ্বান জানাতে পারি, এর বেশি নয়।’
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি পর্যালোচনা দলের সফর প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত সংস্থাটির রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গণমাধ্যমে বলেন, ‘বাংলাদেশে শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রগতি চলমান। ইইউর জিএসপি পর্যালোচনা দলের সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারসহ যাদের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিল, সবার সঙ্গেই বৈঠক হয়েছে। জিএসপি সংক্রান্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে কোথায় সহযোগিতার প্রয়োজন প্রতিনিধি দল তা বুঝতে পেরেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম অধিকার নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর সম্পর্ক বেশ পুরনো। অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইইউর মিল রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ নিজস্ব ভঙ্গিতে কাজ করে। ইইউ যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে তাতে ভালো ফল আসছে। শ্রম অধিকারের বিষয়গুলো সমাধান করতে ইইউর বাজারে বাংলাদেশের জন্য ২০৩২ সাল পর্যন্ত সময় রয়েছে।’ সার্বিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, মানব-শ্রমিক অধিকার ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণ-বাস্তবায়নে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী। শ্রমিকদের প্রাপ্য ন্যায্যতা সম্পর্কে সরকার-মালিক-শ্রমিকদের সম্মিলিত প্রয়াস দেশের সব শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ শ্রমবাজারে অতি উঁচু মানবিকতায় সুপ্রতিষ্ঠিত। বৈশ্বিক কোনো ধরনের অযৌক্তিক চাপ দেশে বৈরী পরিবেশ তৈরিতে সব কূটচক্র পরাভূত হবেই- নিঃসন্দেহে এটুকু দাবি করা মোটেও অমূলক নয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২