শহীদদের সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রাথমিকভাবে ১৯৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা সরকারি গ্যাজেটে প্রকাশ হয়েছে। তবে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, এক হাজারের বেশি বুদ্ধিজীবীকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৫২ বছরেও এই এক হাজার শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে তাদের স্বীকৃতি ও সম্মান জানানো হয়নি। এটি জাতির জন্য দুঃখজনক। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের শুরু যদিও ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড স্মরণ দিবস হিসেবে, তবুও এখন ওই দিবস পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি উৎসর্গ করে। এটি অবশ্যই ভালো প্রবণতা।
কোনো শহীদ বা শহীদ বুদ্ধিজীবীকে ছোট কিংবা বড় করে দেখা কখনই উচিত নয়। এ জন্য কোনো রকম বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার যে সরকারি প্রয়াস সাধুবাদ প্রাপ্য, সেটি হলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুমোদিত সরকারি গ্যাজেটে শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা, সেটি বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে সহস্রাধিক শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবীসহ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কাজেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শহীদ অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির শহীদ জহির রায়হানÑ সবাই শহীদ বুদ্ধিজীবী; শুধু ঢাকা শহর নয়, সারাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী।
বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় নানাভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য শহীদ পরিবাবের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। আবার ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের এককাতারে এনে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অস্বস্তিকর করে তুলেছে। শহীদ সন্তানদের মধ্যে অবিশ্বাস, অসম্মান, হীনম্মন্যতা, সুপিরয়রিটি কমপ্লেক্স ঢুকিয়ে দিতে তারা কার্পণ্য করেনি। আর এতে কিছুটা সফলকামও হয়েছে। আমরা আশা করব, প্রাণখোলা আলাপের মধ্য দিয়ে ক্রমেই আমাদের দূরত্ব কমিয়ে আমরা শহীদ পরিবারগুলো আরও কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারব।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তথা শিক্ষা ও গবেষণায় প্রাধান্য কম পেয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের শক্তিক্ষয়ের জন্য বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সামরিক কৌশল। বিদেশি ও সামরিক বিশ্লেষণে এই কৌশলের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকের মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করতে তিনটি সামরিক কৌশল ব্যবহৃত হয়। তবে ভিন্নমতও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এ তিনটির মধ্যে এক. অপারেশন সার্চলাইট : ২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক এলাকায় অতর্কিত হামলার মাধ্যমে অল্প সময়ে যত বেশি মানুষকে হত্যা করে সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও মনোবল দুর্বল করে দেওয়া যায়; দুই. সার্চ অ্যান্ড ডিস্ট্রয় : সারাদেশে খুঁজে খুঁজে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, নারী নির্যাতনের পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধ সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে দমন করা; তিন. স্করচড আর্থ : শত্রুপক্ষের সব সম্পদ এমনভাবে ধ্বংস করা যেন তারা আর ওই সম্পদ কোনো কাজে লাগাতে না পারে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মুক্তিযুদ্ধের সময় বলা যায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় কৌশল একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি সব সম্পদের মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা, আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ছাড়াও মানবসম্পদকে যুক্ত করা হয়েছে। তথ্যনির্ভর কোনো কোনো গ্রন্থে ডিসেম্বরের ‘ইন্টেলেকচুয়াল অপারেশন’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কাজেই ওই অপারেশন স্করচড আর্থসামরিক কৌশলের আধা সামরিক বাস্তবায়নের অংশ। এই অপারেশনের দায়িত্ব ছিল চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের ওপর। এটিরও তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে যেটুকু তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়- তা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বুদ্ধিজীবীরা ওই তিন কৌশলের প্রয়োগেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাবিদ ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে পারেন, অনেকভাবে মুক্তির সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি এ বুদ্ধিজীবীরাই বছরের পর বছর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের তিনটি সেনা কৌশলের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। কিন্তু উদ্দেশ্য একÑ যুদ্ধের যে পরিণতিই হোক না কেন, বাংলাদেশকে শেষ করা দেওয়া। প্রথম কৌশল প্রয়োগে পাকিস্তানিদের নিজস্ব অস্ত্র, বাহিনী ও গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া আর কিছু ব্যবহৃত হয়নি। বাকি দুই কৌশলে ক্রমেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গঠিত ও প্রশিক্ষিত বেসামরিক গোষ্ঠী (শান্তি কমিটি) এবং আধা সামরিক বাহিনীগুলোকে (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) কাজে লাগানো হয়। বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু প্রথম থেকেই টার্গেট, সেহেতু হত্যা করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তৈরি করা হচ্ছিল এটিই স্বাভাবিক। সবচেয়ে সহজ ছিল পাকিস্তান শাসন আমলে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় পাকিস্তানের শোষণনীতির বিরুদ্ধে এবং বাঙালিদের অধিকারের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক ও প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া।
১৯৭২ সালে পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি আর রাজাকার জল্লাদ আশরাফুজ্জামানের যে ডায়েরি উদ্ধার হয়েছিল, সেখানে ডিসেম্বরের নিখোঁজ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ছাড়াও আরও বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ না হলে আরও বুদ্ধিজীবীকে হারাতে হতো। এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির কৃতকর্মের বিচার ও প্রাপ্য শাস্তি দাবির মাধ্যমে সুবিচার চাওয়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর ন্যায্য অধিকার। এই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির জন্যও নয়; বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাগরিক হিসেবে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা ও সুবিচারপ্রাপ্তির অধিকার রাখে আমাদের মতো সব ভুক্তভোগী পরিবার। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান এই ন্যায়বিচারের স্বস্তি এনে দেয়। আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার নীলনকশা অনুযায়ী স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আলবদর বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ছিল আশরাফুজ্জামান খান। আর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ছিল ওই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’। তারা দুজনই জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিল। একই সঙ্গে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের সাজা প্রদানের ১০ বছর পরও ওই রায় কার্যকর করার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে স্বস্তি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
১৯৭২ সালে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আশরাফুজ্জামান আছে যুক্তরাষ্ট্রে আর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা নেই। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শহীদ জায়া প্রয়াত হয়েছেন। তবে আমরা সেই শহীদদের উত্তরসূরিরা আশা করি, আরও কিছুদিন জীবিত ও সুস্থ আছি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির একটি পর্বের সমাপ্তি শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর প্রত্যাশা। একই সঙ্গে প্রত্যাশা যে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সব বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সম্মিলিত দাবি জোরদার হবে।
আসিফ মুনীর : শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান, মানবাধিকার ও সংস্কৃতিকর্মী
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২