পদোন্নতি বঞ্চনা আর অভিশাপের শেষ কোথায়
তারুণ্যের আকাক্সক্ষা চিরন্তন ও সর্বজনীন। ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ কবি আলফ্রেড টেনিসন তার টিথোনাস কবিতায় এই প্রত্যাশা পূরণ করে দেখিয়েছেন যে, আসলে কোনো স্থির বা স্থবির অবস্থাই মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না, মানুষ আদতে ভালোবাসে গতি ও পরিবর্তন। উষার দেবী অরোরার কাছ থেকে টিথোনাস তার প্রত্যাশিত অমরত্ব পেয়ে অনুধাবন করেছিল যে, এই স্থির অমরত্ব আসলে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ; এর চেয়ে বরং মৃত্যুই শ্রেয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিবঞ্চিত প্রায় ২৪০০ প্রভাষকের মানসিক অবস্থা এখন অনেকটা এ রকম। তারা অনেকেই এক যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে ‘তরুণ’ প্রভাষক থেকে থেকে ক্লান্ত। এখন তারা তাদের পদবির পরিবর্তন পেতে মরিয়া।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস এক ভীষণ ‘ক্রেজ’-এর নাম। প্রতিবছর এত বেশি চাকরিপ্রার্থী এই পরীক্ষা নামক মহাযজ্ঞে অবতীর্ণ হন যে, পত্রিকায় শিরোনাম হয়- এ বছরের বিসিএস পরীক্ষার্থী/আবেদনকারীর সংখ্যা কোনো কোনো দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। সেই লাখ লাখ প্রতিযোগীর মধ্য থেকে তুমুল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনটি (প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা) ধাপে বাছাইকরণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে একটি ক্যাডার পেলে নিশ্চয়ই আর কোনো চিন্তা থাকার কথা নয়। কিন্তু না, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে এলে দেখবেন আপনি সমস্যা আর বঞ্চনার সমুদ্রে এসে পড়েছেন।
বাড়তি সুযোগ-সুবিধার কথা বলছি না, কোনো চাকরির ন্যূনতম প্রাপ্য বিষয়গুলো হলো বেতন, ছুটি, পদোন্নতি, ভাতা, গ্র্যাচুইটি (অবসরকালীন), পেনশন ইত্যাদি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদানের পরে চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য বিভাগীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। সেখানে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১’ অনুযায়ী পদোন্নতির শর্ত হিসেবে পড়েছিলাম যে, চাকরি স্থায়ীকরণ, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাস এবং পাঁচ বছরের ফিডারকাল সম্পন্ন করা। এই শর্তগুলো পূরণ হলে প্রভাষকদের ষষ্ঠ গ্রেডপ্রাপ্তি তথা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। অন্যান্য ক্যাডারে এই পদোন্নতি নিয়মমাফিক বাস্তবায়িত হলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিত্র আলাদা। এর মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থা বেশি করুণ এবং শিক্ষকদের পদোন্নতি চাইতে গিয়ে ও পেতে গিয়ে একদম উচিত শিক্ষা হয়ে যায়! বর্তমানে শিক্ষা ক্যডারের ৩২তম ও ৩৩তম ব্যাচের চার শতাধিক কর্মকর্তা সার্ভিসে যোগদানের ১২ বছরের অধিক সময়কাল পার করলেও একটিও পদোন্নতি পাননি। এক যুগ ধরে ‘এন্ট্রি পোস্ট’-এ কর্মরত থাকার উদাহরণ অন্য কোনো ক্যাডারে নেই। এটি কি অত্যন্ত সুস্পষ্ট বঞ্চনা ও অবহেলা নয়? এ ছাড়া ৩৪তম বিসিএস ১০ বছর, ৩৫তম বিসিএস ৯ বছর, ৩৬তম বিসিএস ৭ বছর কর্মকাল পার করেও পদোন্নতি পায়নি। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির লক্ষ্যে গ্রেডেশনভুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৩২তম বিসিএসে ৫৪, ৩৩তম বিসিএসে ৩৬১, ৩৪তম বিসিএসে ৬৩১, ৩৫তম বিসিএসে ৭৪০, ৩৬তম বিসিএসে ৪৬০ এবং ৩৭তম বিসিএসে ১৫৩ জন। সর্বমোট ২৩৯৯ জন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করে অন্তহীন অপেক্ষার কঠিন? পরীক্ষা দিচ্ছেন। এই ক্যাডারে এখন ৩২ ব্যাচের অনেক সিনিয়র শিক্ষকও প্রভাষক, আবার সদ্য যোগদানকৃত থেকে ৪৩ ব্যাচও প্রভাষক। এটি নিশ্চিতভাবেই ক্যাডারের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও শৃঙ্খলার পরিপন্থি। আবার অন্য বেশ কয়েকটি ক্যাডারের ৩৭ ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের ৩২ ব্যাচ নবম গ্রেড আর অন্য ক্যাডারে ৩৭ ব্যাচ ষষ্ঠ গ্রেড। এ ধরনের পদোন্নতির ব্যবস্থা সব দিক থেকে হতাশা, বিশৃঙ্খলা ও অসামঞ্জস্য তৈরি করে। সঙ্গে সঙ্গে চাকরিবিধি এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদার ক্রম লঙ্ঘিত হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সার্ভিস রুলে থাকার পরও কেন বিধিসম্মতভাবে পদোন্নতি হচ্ছে না? সারা পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে স্বাভাবিক নিয়মে পদোন্নতি হবে। শিক্ষা ক্যাডারে এত ব্যতিক্রম কেন? এর প্রধানতম কারণ হলো মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার অভাব, অনীহা ও উন্নাসিকতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, পদোন্নতিযোগ্য অধিকাংশ কর্মকর্তাই সহকারী অধ্যাপকের বেতন স্কেলে আছেন। অর্থাৎ এই পদোন্নতিতে সরকারের কোনো আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে না। এটা কেবল যোগ্যদের প্রাপ্য পদবি পাওয়ার বিষয়। এটি কেবল ন্যায্যতার প্রশ্ন। চাকরিজীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রভাষক ডাক শুনে শুনে ক্লান্ত তারা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
যে কোনো চাকরি বা কাজে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে প্রণোদনা। আর পদোন্নতি হলো অন্যতম বেসিক প্রণোদনা, যা বিধিসম্মতভাবে প্রাপ্য অধিকার। শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের জন্য এই অধিকারকে বানানো হয়েছে বিশেষ সুবিধা। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য ক্লাসরুম বাদ দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো একজন শিক্ষকের জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর, অবমাননাকর ও বিব্রতকর। ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির যে বিধি ও অধিকার আমাদের রয়েছে সেটি আদায়ের জন্য কেন বারবার চেষ্টা করতে হবে? কেন সেটা নানাভাবে বছরের পর বছর ধরে চাইতে হবে? কেন অন্যদের অনুকম্পার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হবে? পদোন্নতি না পেলে আমরা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হই; অনেকেই ভেবে থাকেন যে আমরা বোধহয় পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি। পদোন্নতিজনিত অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে পেশাগত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। আর একই পদে বছরের পর বছর আটকে থাকার আর্থিক ক্ষতি তো থাকছেই।
আমরা এভাবে আমাদের মূল্যবান সময় ও শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাকাল নষ্ট করতে চাই না। এতে শিক্ষার্থী, শিক্ষাব্যবস্থা তথা পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি সুস্থ শিশুর জন্য যেমন সুস্থ-সুখী মায়ের প্রয়োজন, তেমনি সুস্থ-সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অবশ্যই সন্তুষ্ট শিক্ষক দরকার।
উল্লিখিত অবস্থার মধ্যে ২০ নভেম্বর মাঝরাতে যোগ্য ২৩৯৯ জন প্রভাষকের মধ্যে ১৮৮৪ জনের পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মুরশিদা খানম : বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গৌরনদী সরকারি কলেজ, বরিশাল
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!