মাইক্রোগ্রিন্স প্রযুক্তি পুষ্টির স্মার্ট সমাধান

রাধেশ্যাম সরকার
২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৪
শেয়ার :
মাইক্রোগ্রিন্স প্রযুক্তি পুষ্টির স্মার্ট সমাধান

সম্প্রতি পুষ্টিসচেতন মানুষের আলোচনায় ‘মাইক্রোগ্রিন্স’ এক নতুন আশার নাম হয়ে উঠেছে। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় যখন টাটকা ও বিষমুক্ত সবুজ খাবার পাওয়া দুষ্কর, তখন এই ক্ষুদ্র চারাই হয়ে উঠছে পুষ্টির সহজ ও কার্যকর উৎস। অল্প জায়গায়, কম সময়ে এবং খুব সামান্য পরিশ্রমেই মাইক্রোগ্রিন্স চাষ করা যায় বলে এটি শহুরে কৃষির এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। রাসায়নিক সার ছাড়াই জন্ম নেওয়া এই কোমল সবজি শুধু স্বাদে অনন্য নয়, বরং স্বাস্থ্য রক্ষায়ও অসাধারণ ভূমিকা রাখে। পরিবারে পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা থেকে শুরু করে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ খুলে দেওয়া পর্যন্ত মাইক্রোগ্রিন্স এখন হয়ে উঠছে সবুজ সম্ভাবনার প্রতীক।

মাইক্রোগ্রিন্স হলো এমন তরুণ উদ্ভিজ্জ চারা যা বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার ৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা হয়, তখন গাছে দুটি সত্যিকারের পাতা দেখা যায়। এ পর্যায়ে গাছ ছোট থাকলেও এতে তৈরি হয় গভীর পুষ্টি, উজ্জ্বল রঙ এবং মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ। স্প্রাউটের তুলনায় এটি কিছুটা বড় এবং পূর্ণবয়স্ক সবজির তুলনায় ছোট হলেও স্বাদ ও পুষ্টিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাই একে পুষ্টির আধার বলা হয়, কারণ সামান্য পরিমাণেই এতে ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের উপস্থিতি থাকে। সাধারণত ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। কাণ্ড ও পাতা যখন দুই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হয়, তখন মাটি থেকে সামান্য ওপরে কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া হয়। পালংশাক, সরিষা, মুলা, মেথি, ছোলা, গম, ভুট্টা, ব্রকোলি, কেল, বাঁধাকপি, লেটুস, লালশাক, গাজর, বিট, ধনেপাতা, তুলসী, সূর্যমুখী এবং নানা ডালজাত ফসল থেকে সহজেই মাইক্রোগ্রিন্স উৎপাদন করা যায়। এই তরুণ সবজিগুলো শুধু স্বাদ ও রঙেই নয়, আমাদের খাদ্যতালিকায় আনে প্রাকৃতিক পুষ্টির সতেজতা।

মাইক্রোগ্রিন্স পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সাধারণ সবজির তুলনায় এতে পুষ্টিগুণ কয়েক গুণ বেশি থাকে; অনেকের মতে, এই পরিমাণ চারগুণ পর্যন্তও বাড়তে পারে। ছোট্ট এই চারাগুলো ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং এনজাইমের উৎকৃষ্ট উৎস। গবেষণায় দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক উদ্ভিদের তুলনায় মাইক্রোগ্রিনে পুষ্টি উপাদান অনেক বেশি ঘন থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লাল বাঁধাকপির মাইক্রোগ্রিনে সাধারণ বাঁধাকপির তুলনায় ছয়গুণ বেশি ভিটামিন সি এবং চুয়াল্লিশ গুণ বেশি ভিটামিন ই থাকতে পারে। বেশির ভাগ মাইক্রোগ্রিনেই অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা খুব বেশি, যা কোষের ক্ষতি কমায় এবং শরীরকে সুরক্ষা দেয়। ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড ও পলিফেনল জাতীয় উপাদান এতে প্রচুর থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁঁকি কমে। এটি হজমপ্রক্রিয়া উন্নত করে, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের আশঙ্কা হ্রাস করে। মাইক্রোগ্রিনে ফাইবার, ভিটামিন সি, ই, কে, বিটা ক্যারোটিন, পটাশিয়াম, লৌহ ও ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। ফলে এটি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে মাইক্রোগ্রিন্স চাষ এখনও তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ও ছাদবাগানপ্রেমী এখন মাইক্রোগ্রিন্স চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। শহরের ছোট্ট পরিসরে কিংবা বাসার ছাদে ট্রে ব্যবহার করে অল্প বিনিয়োগে ফসল ফলানো সম্ভব হওয়ায় এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে এক আকর্ষণীয় কৃষি উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরেই প্রায় ৪০০টিরও বেশি ছাদবাগানে নিয়মিতভাবে মাইক্রোগ্রিন্স চাষ হচ্ছে এবং এই সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সহজ চাষপদ্ধতির কারণে এটি ধীরে ধীরে শহুরে কৃষির এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে এখন নানা ধরনের মাইক্রোগ্রিন্স চাষ হচ্ছে, যার মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি স্বাদ, রঙ ও পুষ্টিগুণের জন্য বিশেষ জনপ্রিয়। সূর্যমুখীর মাইক্রোগ্রিন্স সবচেয়ে বেশি চাষ হয়, কারণ এটি প্রোটিন ও জিংকে সমৃদ্ধ এবং সহজে বাড়িতে উৎপাদন করা যায়। মুগডাল মাইক্রোগ্রিন্সও দ্রুত অঙ্কুরিত হয় ও সহজ পরিচর্যায় বৃদ্ধি পায়, তাই এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। বীটরুট মাইক্রোগ্রিন্স তার গাঢ় বেগুনি রঙ এবং আয়রন ও ফলেটের জন্য পরিচিত। ব্রকোলি মাইক্রোগ্রিনের ক্যানসার প্রতিরোধী গুণ একে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মাইক্রোগ্রিন্স চাষের জন্য বড় জমির প্রয়োজন হয় না, বরং ফ্ল্যাটের বারান্দা, ছাদ বা জানালার পাশে ছোট একটি ট্রেতেই সহজে এটি চাষ করা যায়। অল্প জায়গায়, কম খরচে এবং স্বল্প সময়ে সবুজ ফসল পাওয়া যায় বলেই এই চাষপদ্ধতি শহুরে মানুষের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়। চাষের জন্য প্রয়োজন কিছু সহজ উপকরণ; একটি ট্রে বা বীজ বপনের বাক্স, কোকোপিট বা বালু-মাটির মিশ্রণ, যা মাটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ভালো মানের অর্গানিক বীজ, যা রাসায়নিকমুক্ত এবং দ্রুত অঙ্কুরিত হয় এবং একটি পানি ছিটানোর বোতল, যা দিয়ে প্রতিদিন হালকা করে আর্দ্রতা বজায় রাখা যায়। সব উপকরণই স্থানীয় বাজারে বা অনলাইনে সহজে পাওয়া যায়।

শহুরে কৃষির বিকাশ, স্বাস্থ্যসচেতনতার বৃদ্ধি এবং অর্গানিক খাদ্যের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ মাইক্রোগ্রিন্সকে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি শুধু পরিবারের দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না, বরং তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সবুজ উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা। টেকসই ভবিষ্যতের পথে মাইক্রোগ্রিন্স তাই হতে পারে এক নবজাগরণের সূচনা। যেখানে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবেশ মিলেমিশে গড়ে উঠবে একটি সচেতন ও সবুজ বাংলাদেশ।


রাধেশ্যাম সরকার : কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

মতামত লেখকের নিজস্ব