প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিন

গাজীপুরে কারখানায় আগুন

সম্পাদকীয়
২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩০
শেয়ার :
প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিন

গাজীপুরে একই অঞ্চলে দুটি অগ্নিকাণ্ড- একটি কয়েল উৎপাদন কারখানায় এবং আরেকটি ঝুটগুদামে। এই দুর্ঘটনা দুটি আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরল দেশজুড়ে শিল্প ও গুদাম এলাকায় ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। শিরিরচালা এলাকায় ‘ফিনিশ’ নামের কয়েল কারখানায় আগুন মুহূর্তেই গোডাউন থেকে ছড়িয়ে পুরো কারখানাকে কালো ধোঁয়ার আবরণে ঢেকে ফেলে; অন্যদিকে শ্রীপুরের নাকিব স্পিনিং মিলের সামনে ঝুটগুদামে রাতের আঁধারে লেগে যাওয়া আগুন ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। দুটি ঘটনাই দেখায়, শিল্পাঞ্চলে কী ভয়াবহ ঝুঁঁকির মধ্যে শ্রমিক, স্থানীয় মানুষ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ প্রতিদিনই নিরুপায় অবস্থায় থাকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, গাজীপুর দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প অঞ্চল। এখানে কারখানা, ঝুটগুদাম, গুদামঘর, ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। অথচ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর। ‘ফিনিশ’ কয়েল কারখানায় আগুন লাগার পর কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়া এবং গোটা এলাকায় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হওয়া প্রমাণ করে যে, সেখানে দাহ্য রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সংযোগ কিংবা সংরক্ষণব্যবস্থা- কোথাও গুরুতর ত্রুটি বিদ্যমান ছিল। কয়েল উৎপাদনকারী কারখানায় দাহ্য পদার্থের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে; তাই এমন কারখানায় বিজ্ঞানসম্মত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, তাপ সেন্সর, অটোমেটিক স্প্রিংকলার, জরুরি নির্গমন পথ এবং প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মী থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবতা হলো- অধিকাংশ কারখানাই কাগজে-কলমে নিরাপত্তার কথা লিখলেও বাস্তবে তার সামান্য অংশও কার্যকর রাখে না।

আর ঝুট অর্থাৎ বস্ত্রশিল্পের অবশিষ্টাংশ- দাহ্যতার ঝুঁকি এ ক্ষেত্রে আরও বিপজ্জনক। অথচ দেশে শত শত ঝুটগুদাম আবাসিক এলাকার পাশে, রাস্তার ধারে, বাজারসংলগ্ন স্থানে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে। আগুন লাগলে স্থানীয় মানুষ ড্রাম থেকে, পুকুর থেকে পানি এনে নিজেরাই নেভানোর চেষ্টা করে। অথচ এসব ঝুঁকির দায় কারও নয়- এমন ধারণাই যেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি কারখানার ক্ষতি নয়, এটি শ্রমিকের জীবন, স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশের ভারসাম্য এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর বহুমাত্রিক ক্ষত রেখে যায়। কারখানা বা গুদামের আগুন মানে শুধু মালপত্র হারানো নয়; শ্রমিকদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে, উৎপাদন বন্ধ থাকে, সরবরাহ শৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত হয়। স্থানীয় বাজার, ছোট ব্যবসা, এমনকি পরিবেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে না। তাই অগ্নিকাণ্ড শুধু শিল্পক্ষেত্রের সমস্যা নয়; এটি সামাজিক ও পরিবেশগত সংকটও।

এই বাস্তবতায় এখন জরুরি প্রয়োজন শিল্পাঞ্চলগুলোতে এককেন্দ্রিক নিরাপত্তা তদারকি ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি কারখানার আগুন প্রতিরোধ সক্ষমতা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনা নিয়মিতভাবে যাচাই করা হবে। সব ঝুটগুদামকে আবাসিক এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া, নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং অগ্নি-বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা অপরিহার্য। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো, জনবল বৃদ্ধি, আধুনিক সরঞ্জাম যোগ করা এবং শিল্পাঞ্চলে সাবস্টেশন স্থাপন করাও সময়ের দাবি। আরও প্রয়োজন হলো প্রতিটি কারখানায় বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত মহড়া, নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।

গাজীপুরের এই দুটি ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানি না হলেও এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। আজ যে আগুন গুদাম পুড়িয়েছে, কাল তা মানুষের জীবন কেড়ে নিতেও পারে। আমরা কি প্রতিবারই একই অবহেলা, একই ত্রুটি এবং একই পরিণতির অপেক্ষায় থাকব? নাকি এবার সত্যিই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে শিল্পাঞ্চলগুলোকে নিরাপদ, টেকসই এবং মানবিক করে তুলব? এখন সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার সময়- আর দেরি নয়।