তরুণ প্রজন্মের আচরণ

সাদিয়া ইসলাম কাসফিয়া
২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৩
শেয়ার :
তরুণ প্রজন্মের আচরণ

আধুনিক সভ্যতার গতি আজ তথ্যপ্রযুক্তির ডানায় ভর করে আকাশছোঁয়া অগ্রযাত্রা করেছে। একসময় যে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল সময়সাপেক্ষ ও সীমাবদ্ধ, প্রযুক্তির হাত ধরে তা আজ হয়েছে মুহূর্তের খেল। এই দ্রুতগতির যুগে মানুষের যোগাযোগ, বিনোদন, জ্ঞানার্জন- সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করছে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাটসহ অসংখ্য প্ল্যাটফর্মে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব প্ল্যাটফর্ম তরুণদের চিন্তাধারা, আচরণ, স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও মানসিকতাকে গভীরভাবে আকার দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া যেন আজ তরুণদের আরেকটি ‘অদৃশ্য বাসস্থান’- যেখানে তারা যেমন শিখছে, তেমনি কখনও হারিয়েও যাচ্ছে।

তরুণ প্রজন্মের সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির পেছনে প্রধান কারণগুলো মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক। একটি স্ক্রল বা একটি ‘লাইক’ পেলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা সাময়িক আনন্দ এবং সন্তুষ্টির অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতির পুনরাবৃত্তি পাওয়ার আকাক্সক্ষাই আসক্তির জন্ম দেয়। তাছাড়া ভার্চুয়াল জগতে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ ও ‘ফলোয়ার’-এর সংখ্যা তরুণদের মধ্যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির ভ্রম তৈরি করে। এই বাহ্যিক স্বীকৃতির তাগিদ তাদের প্ল্যাটফর্মে আরও বেশি সময় কাটাতে প্রলুব্ধ করে। রয়েছে ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ অন্যদের জীবনযাত্রা, সাফল্য বা আনন্দ উপভোগের চিত্র দেখে তরুণদের মনে এক ধরনের পিছিয়ে পড়ার ভয় জন্মায়, যা তাদের ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়া চেক করতে বাধ্য করে। আবার একঘেয়েমি কাটাতে বা তাৎক্ষণিক বিনোদনের জন্য রিলস বা শর্টসের মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল কনটেন্ট অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই সহজলভ্যতা দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ ও ধৈর্যের অভ্যাসকে ব্যাহত করে। পরিবারের অসচেতনতার জন্যও কখনও কখনও তরুণ সমাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর হয়ে পড়েছে।

অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রভাব তরুণদের জীবনযাত্রায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। তাদের মনোসংযোগের ঘাটতি ও শিক্ষাজীবনে ক্ষতি হয়। নিয়মিত স্ক্রলিং মস্তিষ্কে দ্রুত আনন্দের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়, ফলে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকের ফলাফল নিম্নগামী হয়। আবার অন্যের সাজানো-গোছানো জীবন দেখে নিজের বাস্তবতাকে তুচ্ছ মনে হতে থাকে। এতে হতাশা, আত্মবিশ্বাসহীনতা বা ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। বহু বন্ধুর ‘ভার্চুয়াল তালিকা’ থাকা সত্ত্বেও বাস্তব জীবনে অনেক তরুণ একাকিত্বে ভুগছে। সম্পর্ক আগের মতো আন্তরিক নয়, বরং প্রতীকী হয়ে উঠেছে। বেড়েই চলেছে সাইবার অপরাধ; ভুয়া অ্যাকাউন্ট, সাইবার বুলিং, প্রাইভেসি লঙ্ঘন, অনলাইন প্রতারণা- এসব ঝুঁকি তরুণদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তাকে সংকটে ফেলছে। কখনও কখনও ঘুমের ব্যাঘাত, মাথাব্যথা, চোখের সমস্যা, স্থূলতা- এসব নতুন প্রজন্মের ‘ডিজিটাল রোগ’ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

একসময় তরুণদের অবসর কাটত মাঠে খেলাধুলা, বই পড়া, আড্ডা, বিতর্ক, সংগঠন বা নাট্যচর্চার মধ্য দিয়ে। সামাজিক মেলবন্ধন তৈরি হতো মুখোমুখি আলাপ-আলোচনায়। সম্পর্ক ছিল গভীর, আত্মিক, আন্তরিক। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের জীবনযাত্রা অনেকটাই স্ক্রিননির্ভর। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ মানে এখন মেসেঞ্জারের নীল টিক, আর হাসি মানে ইমোজি। মাঠের জায়গায় দখল নিয়েছে অনলাইন গেম; বইয়ের জায়গা ইউটিউবের রেকমেন্ডেড ভিডিও এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার জায়গায় ভার্চুয়াল ফিল্টার। এই পরিবর্তন যেমন সুবিধা এনেছে, তেমনি মানবিক সংযোগ ও আচরণগত পরিপক্বতাকে কিছুটা ভঙ্গুর করে তুলেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু জীবনে নেতিবাচক দিকগুলোই বয়ে আনে না, রয়েছে এর নানাবিধ ইতিবাচক দিকও। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তরুণরা দ্রুত বিশ্বের খবর জানতে পারছে, বিভিন্ন শিক্ষামূলক কোর্স ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছে এবং বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করতে পারছে (যেমন জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সচেতনতা)। এটি বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে তাদের পরিচিতি তৈরি করতে সহায়তা করছে। তাছাড়া অনলাইনে ব্যবসা করার মাধ্যমে অনেকে বানিয়েছে সফলতার অট্টালিকা।

ভারসাম্যের চাবিকাঠি সোশ্যাল মিডিয়া- এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের হাত ধরে যে সম্ভাবনা এসেছে, তাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এটি একটি ধারালো তলোয়ারের মতো, যার সঠিক ব্যবহার জীবনকে সমৃদ্ধ করে, আর ভুল ব্যবহার ডেকে আনে সর্বনাশ। মনে রাখতে হবে, ভার্চুয়াল জগৎ যতই রঙিন হোক না কেন, জীবনের মূল সুরটি বাঁধা আছে বাস্তবের জমিনে। ভারসাম্য হলো এই যুগের তরুণদের মূলমন্ত্র। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে হবে, তবে নিজেকে আসক্তির বেড়াজালে বন্দি করা চলবে না। যদি এই মাধ্যমকে সঠিকভাবে জ্ঞানার্জন, ইতিবাচক সংযোগ স্থাপন ও সৃজনশীলতার বিকাশে কাজে লাগানো যায়, তবেই তারা আগামী দিনের সমৃদ্ধির সোপান গড়তে পারবে। অন্যথায়, একাকিত্বের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই আসুন আমরা ‘স্ক্রল’ থেকে ‘সাফল্যের’ পথে নিজেদের চালিত করি এবং ডিজিটাল বিশ্বের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করি।

সাদিয়া ইসলাম কাসফিয়া : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়