দায় শুধুই বিনিয়োগকারীদের নয়
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন এসেছে সম্প্রতি পাঁচটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মার্জারের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও এক্সিম ব্যাংক (বাংলাদেশ) পিএলসি। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিয়ে একটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠন করাকে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ম্যাক্রো-আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। তাদের যুক্তি, খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, লিকুইডিটির চাপ ও মূলধন ঘাটতিÑ এমন বহু বছরের সঞ্চিত সমস্যার সমাধানে এটিই ছিল ‘শেষ বিকল্প’।
কিন্তু এই মার্জারের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো, দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান সব শেয়ারহোল্ডারের শেয়ার মূল্য শূন্য ধরা, অর্থাৎ তাদের মালিকানা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাষায় এটি ‘আইনসম্মত’; কারণ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি পুরোপুরি রাইট-অফ করার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের আছে। এ কথা সত্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কথা হলো, আইনসংগত মানেই কি তা ন্যায়সংগত?
একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত, কতটা স্বচ্ছ এবং কতটা ন্যায়সংগতÑ এই তিনটি মানদণ্ডে বিচার করেই জনস্বার্থে নীতি নির্ধারণ করা উচিত। আর এখানেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা সমানভাবে বাড়ছে। যদি ক্ষতির কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে দুর্বল ব্যাংকের দায় একমাত্র শেয়ারহোল্ডারের কাঁধে দিয়ে অন্যদের ক্ষেত্রে বেশ একটা দায়মুক্তি দেওয়ার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছে ব্যাপারটিতে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
একটি ব্যাংক দুর্বল হওয়ার ইতিহাস এক দিনে তৈরি হয় না। বছরের পর বছর দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অযাচিত ঋণ বিতরণ এবং নিয়মিত অডিটের ব্যর্থতাÑ সবকিছু মিলেই একটি ব্যাংক ক্রাইসিসে পড়ে।
এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে পরীক্ষা-তদন্তে দেখা গেছে, তাদের নন-পারফর্মিং লোন বা অনিষ্পন্ন ঋণ অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় রয়েছে। যেমন, ইউনিয়ন ব্যাংকের এনপিএল রেট প্রায় ৯৭.৮% হিসেবে উদ্ধৃত। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির প্রায় ৯৬.৩৭%। মানে তারা যদি ১০০ টাকা লোন দিয়ে থাকে তার ৯৬.৩৭%-ই খেলাপি ঋণ। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচটি ব্যাংকে মোট প্রায় ১.৪৭ লাখ কোটি ঋণ অনিষ্পন্ন রয়েছে।
কিন্তু এসব ব্যর্থতার পুরো দায়ই শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া হচ্ছে তাদের শেয়ারের মূল্য শূন্য করে। কোনোভাবেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বা সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা এই ঝুঁকি তৈরি করেননি। তবু মার্জারের পরিণতিতে সব দায় চাপানো হলো শেয়ারহোল্ডারদের ওপর, তাদের সমগ্র বিনিয়োগ শূন্যে নামিয়ে এনে।
বছরের পর বছর যে পর্ষদ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণ করেছে, তারাই ঝুঁঁকির মূল উৎস ছিল। দুর্বল ঋণ অনুমোদন, সংশ্লিষ্ট পক্ষকে ঋণ বিতরণ, অডিট রিপোর্ট উপেক্ষাÑ এসব ইস্যুতে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো হাত নেই। পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপারে সরকার কী শাস্তির ব্যবস্থা নিল?
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ, ক্রেডিট রেটিংÑ এসব কোথায় ছিল? যদি একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বা ঝুঁঁকি ২-৩ বছর আগে থেকেই বাড়তে থাকে, তাহলে সময়মতো ‘প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন’ বা বিশেষ পর্যবেক্ষণ কেন দেওয়া হলো না? কারণ তখনকার সরকার চায়নি। কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকার কারও শাস্তি হয়েছে?
এর পরে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে খেলাপি সংস্কৃতি, মামলা নিষ্পত্তির ধীরগতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করেছে। কিন্তু এই বড় সমস্যাগুলোর দায়ও আসলে শেয়ারহোল্ডারদের ওপর এককভাবে চাপানো হলো।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, ব্যাংক সংকট হলে তিনটি পথ সাধারণত অনুসরণ করা হয় : ১. বেইল ইন (শেয়ার রাইট-ডাউন বা কনভার্শন), ২. বেইল আউট (সরকারি সহায়তা), ৩. শেয়ার কনভার্শন (শেয়ারকে নতুন প্রতিষ্ঠানের কম মূল্যে রূপান্তর করা)। বাংলাদেশে করা হলো প্রথম পদ্ধতি; কিন্তু সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে, পুরো শেয়ার শূন্য করে। যদিও বিশ্বব্যাপী শেয়ারকে শূন্য ধরার ঘটনা বিরল।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, ভারতÑ যেখানেই ব্যাংক সংকট হয়েছে, প্রায় সব দেশেই শেয়ারহোল্ডারদের সম্পূর্ণ রাইট-অফ না করে কনভার্শন রেশিও দ্বারা কম মূল্য রেখে মার্জারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় ব্যাংকিং খাতে ইয়েস ব্যাংক সংকটে পড়লেও ( যদিও ইয়েস ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্জার একদম একই নয়) শেয়ার শূন্য করা হয়নি। তখন মূলধন পুনর্গঠন করা হয়েছিল। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও শেয়ার ডিপ ডিসকাউন্টে কনভার্ট করা হয়। তাই বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত বেশ ব্যতিক্রম এবং ‘অতিরিক্ত’ কঠোর বলা যেতেই পারে।
বাংলাদেশে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার যে ন্যূনতম মানদণ্ড থাকা উচিত ছিল, তা এখানে অনুসরণ করা হয়নি। অবশ্যই শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু তার পরও সব দেশেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেওয়া হয়। এ কথা মাথায় রেখেও শেয়ার কনভার্শন একটি সহজ, যুক্তিযুক্ত ও স্বচ্ছ বিকল্প ছিল সরকারের হাতে।
কনভার্শন রেশিও কী হতে পারত? এটা ঠিক করাই যেত যদি শেয়ারহোল্ডারদের ব্যাপারে কেউ কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করত। উদাহরণ হিসেবে, দুর্বল ব্যাংকের ১০০টি শেয়ারের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকে পাঁচটি বা ১০টি শেয়ার দেওয়া, অর্থাৎ বৃহত্তর মূল্যহ্রাস, কিন্তু সম্পূর্ণ শূন্য নয়।
এতে চারটি সুফল হতো : ১. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ক্ষতি হলেও সম্পূর্ণ ধ্বংস হতো না। ২. মার্জার-পরবর্তী ব্যাংকে তাদের আংশিক মালিকানা থাকত। ৩. বাজারে আস্থার সংকট কম হতো। ৪. পুঁজিবাজারে বিকাশমান বিনিয়োগ সংস্কৃতি রক্ষা পেত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সহজ সুযোগটিই নেওয়া হয়নি।
যখন বিনিয়োগকারী বুঝতে পারেন- ‘এক দিনে সরকার চাইলে আমার শেয়ার শূন্য হয়ে যেতে পারে’Ñ তখন নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যায়। ব্যাংক মার্জারের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে এই অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক নেতিবাচক বার্তা এটি। কারণ যারা দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করে ব্যাংকের শেয়ার কিনেছিলেন, তারা হঠাৎই সব হারিয়েছেন। এটি ভবিষ্যতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও বিনিয়োগ সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর প্রভাব পুঁজিবাজারে আমরা এখনই দেখছি। যে দেশগুলোতে ব্যাংক সংকটে পড়েছে, প্রায় সব দেশেই ক্ষতিপূরণ, কনভার্শন বা পুনর্গঠিত শেয়ারের সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এই নীতির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। দুর্বল ব্যাংক পরিচালনার দায় পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার এবং তা চালিয়ে দিতে যাওয়ার দায় রেগুলেটরি বডির। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
ব্যাংক মার্জার বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত- এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো নীতি তখনই টেকসই হয়, যখন তা ন্যায়সংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়। শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার শূন্য করা আইনসম্মত হলেও তা ন্যায়সংগত হয়নি। দায় শুধু বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়তো সহজ, কিন্তু তা দেশের পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘমেয়াদি আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নিয়ন্ত্রক ও নীতিনির্ধারক সংস্থার উচিত এই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে বিকল্প পথ (যেমনÑ শেয়ার কনভার্শন) পুনর্বিবেচনা করা, যাতে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীর অধিকার, দুটিই সমানভাবে সুরক্ষিত থাকে।
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি
মতামত লেখকের নিজস্ব