সমতার সমাজ কত দূর
‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’ যে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় এই তথ্য অনেকেরই অজানা। আবার অনেকে জানেই না যে এই নামে কোনো দিবস আছে। প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে পুরুষদের ইতিবাচক অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, স্বাস্থ্য ও মানাসিক সুস্থতা এবং সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সর্বোপরি একটি সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অনেকের মনে এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, পুরুষদের অধিকার আদায়, পুরুষ নির্যাতন বন্ধ করার জন্য হয়তো এই দিবস পালন করা হয়।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রকার নেতিবাচক জেন্ডার স্টেরিওটাইপ আছে, যার ফলে শুধু নারীরাই বৈষম্যের শিকার বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কিছু কিছু স্টেরিওটাইপের ফলে পুরুষরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যেমনÑ পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই; পুরুষদের রাগী ও কঠোর হতে হবে, বড় হয়ে কেবল ছেলেরাই পরিবারের দায়িত্ব নেবে; পুরুষদের সাহায্য চাওয়া মানে ব্যর্থতা ইত্যাদি। এর ফলে অনেক পুরুষ হতাশা, মানসিক চাপ ও একাকিত্বে ভোগে। তাদের এই সমস্যাগুলো নিয়ে কারও সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে না, সংকোচ বোধ করে। যার ফলে পুরুষদের উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক নারীদের তুলনায় বেশি।
ছোটবেলা থেকেই একজন ছেলেশিশু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শুনে বড় হয় যে, বড় হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এটি একদিক থেকে যেমন শিশুটিকে তার জীবনের লক্ষ্য পালনের দিকে ধাবিত করে, আবার তেমনি কোনো ক্লাসে কাক্সিক্ষত ফল না হলে সে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভোগে। আমাদের সমাজের করুণ বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষদেরই পরিবারের হাল ধরতে হয়। আবার ৪০ বছর বয়সের পর দায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়; যেমনÑ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের চিকিৎসা খরচ, সংসার খরচ ইত্যাদি। এই সময়ে পুরুষদের মানসিক চাপ ক্রমে বাড়তে থাকে। যার ফলে অনেকের যেমন স্থায়ী ওষুধ সেবন শুরু করতে হয়, আবার অনেকের অকালমৃত্যুও ঘটে।
পুরুষরা যেমন পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করে তেমনি সমাজ ও রাষ্ট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ পুরুষদেরও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করা ও সহানুভূতির প্রয়োজন। এ বছরের আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে ছেলেশিশু ও পুরুষদের সহায়তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব শুধু পুরুষরাই ধারণ করে, লালন করে, পালন করে; কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়। আমাদের সমাজে অনেক নারীও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ধারন করে, লালন করে, পালন করে। বৈষম্যের মূল কারণ পুরুষরা নয়; পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হলে প্রথমে আমাদের ইতিবাচক মানসিকতা, ইতিবাচক আচরণের চর্চা করতে হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আমরা যদি সমতার সমাজ গড়তে চাই তবে আমাদের সমতার চর্চা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতার মনোভাব, দায়িত্বের সমবণ্টন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজই একদিন বড় ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমনÑ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও শিক্ষাক্রম জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। প্রতিটি জেন্ডারের মানুষের ইতিবাচক উপস্থাপনের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তন আসতে পারে। বিশ্বব্যাপী পালিত এই আন্তর্জাতিক দিবসের মাধ্যমে একটি বার্তা আমরা সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই যে সব ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে নারী-পুরুষসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এই দিনটি পুরুষদের প্রতি সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণা বদলানোর সুযোগও এনে দেয়। একজন প্রকৃত পুরুষ মানে সে নারীদের দমিয়ে রাখে না; বরং সমান মর্যাদায় কাছে থাকে। একজন পুরুষও তার দৈনন্দিন কাজের তালিকায় উপার্জন করার পাশাপাশি সন্তান লালনপালন, গৃহস্থালির কাজে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে যাতে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পায়; এ রকম উদাহরণও আমাদের সমাজে অনেক আছে। কিন্তু আমরা সেই পুরুষদের অবদানকে সব সময় স্বীকৃতি দিই না। আমরা নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সবার অবদানকে স্বীকৃতি দিলেই ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যেখানে দায়িত্ববোধ, সম্মান ও সহমর্মিতা একত্রে বিকশিত হবে।
এই আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে আসুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করিÑ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সমান সুযোগ, সম্মান ও সহায়তার পরিবেশ গড়ে তুলব। সমতা মানেই কারও কম নয়, বরং একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ফারজানা আকতার : উন্নয়নকর্মী