জুলাই সনদে টানাপড়েন কমল?

আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬
শেয়ার :
জুলাই সনদে টানাপড়েন কমল?

২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে দাবি ওঠে জুলাই সনদ ঘোষণার। জোর দাবি ছিল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই জুলাই সনদ ঘোষণার। জুলাই আন্দোলনের সিপাহসালাররা জোর তাগিদ দিলেও সরকার পরিহার করে তাড়াহুড়োর পথ। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠন করা হয় ছয়টি সংস্কার কমিশন। সেই কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রায় নয় মাস ধরে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোট নিবিড়ভাবে আলোচনা করে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত, নির্বাসিত ও অভিযুক্ত দল বলেই ঐকমত্য কমিশনে তাদের উপস্থিতি কেউ আশা করেনি। জাতীয় পার্টিও এই মহতী উদ্যোগে আমন্ত্রিত নয়। জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না পাওয়া এনসিপি ঐকমত্য কমিশনে ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দল। সক্রিয় ছিল সেই আমজনতার দল, সনদে স্বাক্ষরের পরও যে দলকে নিবন্ধন লাভের জন্য শতাধিক ঘণ্টার ব্যর্থ অনশন করতে হয়েছে।

যাহোক এসব গুরুত্বপূর্ণ দল কিছু কিছু প্রস্তাবে ভিন্নমত পোষণ করে। মোট ৮৪টি প্রস্তাব গৃহীত হয় এই ঐকমত্য কমিশনে। কথিত মতে, ৩০টি দফায় কারও কোনো ভিন্নমত নেই। তার মধ্যে আছে কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার প্রস্তাবও। ভাবখানা এমন, ভবিষ্যতে তা সে দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ বছর বা তারও পরে যদি নোয়াখালী, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর বা বগুড়া বিভাগ হতে চায় তাহলে এমনতর ঐকমত্য কমিশন লাগবে। অথবা জুলাই জাতীয় সনদ যদি ভোটে হেরে যায় তাহলে কি হেরে যাবে ফরিদপুর বা কুমিল্লার বিভাগ হওয়ার ভাগ্য? তেমনি ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, শতাব্দী প্রাচীন আইনটি সংশোধনের জন্য ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হলেও জামায়াতে ইসলামীসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট সংশোধনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জুলাই সনদ যদি অনুমোদিত হয় আর জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদে বৃহত্তম দল হয়ে সরকার গঠন করে তাহলে কি আমাদের এই পুরনো আইন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে? অথচ ১৯২৩-এর পর এই দীর্ঘসময়ে প্রযুক্তিগত যে উল্লম্ফন ঘটেছে তাতে দাপ্তরিক গোপনীয়তা ফাঁসেরও কত উপায় বেরিয়েছে। মান্ধাতা আমলের আইন যুগোপযোগী করতেও যদি গণভোট লাগে তবে আর সরকারের প্রয়োজন কেন? আল্লাহ মালুম! ভবিষ্যতে সাধারণ নির্বাচন করা জরুরত কিনা এই প্রশ্নেও না আবার গণভোটের আওয়াজ উঠে আসে।

জুলাই জাতীয় সনদের আইনানুগ ভিত্তি নিয়ে মতভেদ ছিল, গণভোট হবে কিনা বা আগে না সংসদ নির্বাচনের দিনে হবে তা নিয়ে মতভেদ। মতভেদ ছিল উচ্চকক্ষে কেমনতর পিআর হবে তা নিয়ে। ভাতের চালে যেমন সিদ্ধ, আতপ, মিলে ছাঁটা, ঢেকি ছাঁটা, মোটা, চিকন নানারকম ধরন পিআরেরও তেমনি নানান রকমফের আছে। পিআরে সম্মতরাও উচ্চকক্ষে ভোট সংখ্যার ভিত্তিতে পিআর হবে নাকি নিম্নকক্ষে নির্বাচিত সদস্য ভিত্তিতে এরই দ্বন্দ্বে ছিল। কদিন বেশ উতোর চাপান চলল। কে হারে কে জেতে দেখার জন্য জনতা ছিল উদগ্রীব। টানাটানি ছিল চতুর্পক্ষীয়। কারও দাবি সনদের আইনানুগ ভিত্তির প্রজ্ঞাপন সই করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে, রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সই করানো যাবে না, যাবে না মানে যাবেই না। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ১৩ নভেম্বর দুপুর আড়াইটায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে। আবারও উৎকণ্ঠাÑ কে জিতল আর কে হারল! জুলাই সনদের আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ায় এনসিপির ভাগে প্লাস ১ পয়েন্ট লাভ হলো, এই সনদ তাদের প্রাণের দাবি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপনে সই করায় আবার ঝুলিতে ঢুকে গেল মাইনাস ১, ফলে হরেদরে শূন্য। জামায়াতে ইসলামীর ললাটে মাইনাস ১ সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট না হওয়ায়, আবার প্লাস ১ পয়েন্ট জুটে গেল উচ্চকক্ষে জাতীয় সংসদের ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বিভাজনের কল্যাণে। ফলে জামায়াতে ইসলামীরও যোগফল জিরো। যে দুই পয়েন্টে জামায়াত মাইনাস ১ ও প্লাস ১ পেয়েছে সেই দুই পয়েন্টেই বিএনপির ভাগে বিপরীতমুখী নম্বর জুটল প্লাস ১ ও মাইনাস ১, বিএনপিরও নিট অর্জন জিরো। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনী মাঠের তিন বড় দলেরই নিট অর্জন জিরো এবং তিনদলই ১-১ এ ড্র করায় মনে হতে পারে কেউই কি জেতেনি? না, এ খেলায় জিতে গেছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জুলাই সনদের আইনানুগ ভিত্তি দিলেন, গণভোটের মঞ্চ তৈরি করলেন এবং উচ্চকক্ষে পিআরের ব্যবস্থা করে ৩-এর মাত্রায় ৩ পয়েন্টই পেয়ে গেলেন।

কেমন হবে ভোটের দিনটি? ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালে মনে হয়েছিল যে ৩২টি দল ও জোট মিলে সংস্কারের সড়ক নির্মাণ করছিলেন তারা সবাই জুলাই সনদের পক্ষে থাকবেন। কাস্টিং ভোটের শতভাগই হ্যাঁ-এর পক্ষে থাকবে বলে অনুমিত ছিল। তবে কেন যেন ১৩ তারিখে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর আলামত দেখে মনে হচ্ছে শতভাগ থই থই অবস্থায় নেই। ইতোমধ্যেই বিএনপির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ‘না’ ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেলেছেন। গণভোটের প্রশ্নে অনুল্লেখ্য থেকে গেল বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্টগুলো। ভোটারের সামনে নোট অব ডিসেন্ট রাখার দাবিতে বিএনপি জোরদার দাবি রাখায় এখন তারা পড়ে গেছে দোটানায়। তারা গণভোটে হ্যাঁ বললে তাদের আপত্তিগুলো অকার্যকর হয়ে যাবে। না বললে জুলাই অভ্যুত্থানের বিপক্ষে অবস্থান বলে চিহ্নিত হতে পারে। একই সংকট আলোচনায় যোগ দেওয়া সব দল ও জোটের। হ্যাঁ বা না দুটোই কাটবে শাঁখের করাতের মতো।

জুলাই সনদের প্রথম ৮৩টি দফা শিক্ষিত ও আগ্রহীরা অল্পবিস্তর বুঝে নিতে পারবেন। তবুও একটি উত্তরে চারটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া এত সহজ নয়। কোনো ভোটারের হয়তো আপত্তি আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে, বাকি সবকটিতে একমত। কেউ হয়তো চান প্রধানমন্ত্রীর দশ বছরের মেয়াদ বেঁধে দেওয়া ঠিক নয়, আর সবে হ্যাঁ। তিনি কী করবেন? উপায়, উত্তরের জন্য দুটো বিকল্প পথ বেছে নেওয়া। প্রথমটি শৈশবের ‘উবু দশ বিশ’ খেলার মতো করে হ্যাঁ বা না যেটিতে বেঁধে যাবে সেটাতেই সিল মারতে পারে। অথবা হতে পারে দফাওয়ারি হ্যাঁ-না গুনে গুনে যেদিকে পাল্লা ভারী সেদিকে অবস্থান নেওয়া। জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল হ্যাঁ ভোটে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভোটাররা ভাবনার দায় থেকে মুক্ত। তবুও খটকায় পড়ে অনালোচিত ৮৪ নম্বর বা শেষ দফায়। এ দফাটি খুবই সংক্ষিপ্ত। সম্ভবত জুলাই সনদের সবচেয়ে ক্ষুদ্র দফা। বয়ান হচ্ছে ‘বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঙঢ়বহ এড়াবৎহসবহঃ চধৎঃহবৎংযরঢ়-এর পক্ষভুক্ত হওয়া।’ ২৩টি দল ও জোট এই প্রস্তাবে একমত। ৫টি দল জাকের পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল। অনালোচিত এই ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ সম্পর্কে না জেনে না বুঝে জনগণ গণভোটে কোনদিকে ঝুঁকবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি?


আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব


মতামত লেখকের নিজস্ব