জাতীয় স্বার্থ বজায় রাখুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৫
শেয়ার :
জাতীয় স্বার্থ বজায় রাখুন

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা এবং পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই। দেশের অন্যতম কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্থাপনা নিয়ে সিদ্ধান্ত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই উদ্বেগ তৈরি করেছে এর অস্বচ্ছতা, তড়িঘড়ি নিয়ে। চুক্তি দুটি প্রকাশ্যে হলেও এর শর্ত, গোপনীয়তা কিংবা আর্থিক দায় কীÑ তা এখনও জানানো হয়নি। নৌপরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, পরে জানানো হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ জড়িত থাকলে পরে নয়, সিদ্ধান্তের আগেই মানুষকে জানানো উচিত।

বিজ্ঞজনরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা, রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা। সাধারণত এ ধরনের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে বিরত রাখাই যুক্তিযুক্ত। কারণ কয়েক মাস পরই নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেবেÑ যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এমন অবস্থায় একটি অস্থায়ী সরকারের দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকাই সঙ্গত।

জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মহলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, এমনকি দেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনায় না এনে চুক্তি করাÑ এটি দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার লক্ষণ নয়।

যেখানে বন্দর একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি, সেখানে চুক্তি নিয়ে গোপনীয়তা থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জাতীয় সম্পদে বিদেশি বিনিয়োগ বা অংশগ্রহণ সর্বদাই খারাপ নয়। সে ক্ষেত্রে তার প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং সংসদীয় পর্যালোচনার আওতায়। নির্বাচিত সরকারও এ ধরনের চুক্তি করলে সংসদে আলোচনা বাধ্যতামূলক। অথচ এখানে সংসদ তো নেই-ই, এর পরিবর্তে একটি অস্থায়ী সরকারের আমলে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকাই সঙ্গত মনে করি।

এ আচরণ স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ তৈরি করেÑ চুক্তির পেছনে কি কোনো বিদেশি লবিস্ট গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে? জনগণের স্বার্থের চেয়ে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্ন উঠছেই। বিদেশি কোম্পানি যেন অপরিহার্য, বাংলাদেশ কিছুই পারে নাÑ এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা একটি পুরনো মনস্তাত্ত্বিক চাপ। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি কম হবেÑ এ যুক্তিও বাস্তবে ভিত্তিহীন। আন্তর্জাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রেও দুর্নীতির উদাহরণ অসংখ্য। তদুপরি চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই মাশুল বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিলÑ নিয়মনীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে রাষ্ট্র চলবেÑ এই ধরনের অস্বচ্ছ চুক্তি হবে পরিত্যাজ্য। মানুষ ভেবেছিল, পুরনো দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক সংস্কৃতি ভেঙে নতুন স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আগের চর্চার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

আজ যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তার বোঝা বহন করতে হবে আগামী প্রজন্মকে। জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সরকারকে চুক্তি প্রকাশ করতে হবে, সংসদীয় নজরদারির মতো সমতুল্য কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পুনর্বিবেচনার পথ খুলে দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, জনগণের জানার অধিকারকে সম্মান করে, দেশের সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার দৃষ্টিভঙ্গিই হওয়া উচিত রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। এই দুটি চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন জানিয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও দ্রুতগতিতে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। তাদের মূল উদ্বেগ হলো চুক্তির শর্তাবলি অস্বচ্ছ এবং দেশের বন্দরের ভবিষ্যৎ সক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যা দেশের স্বার্থের পরিপন্থি।

বাংলাদেশ তখনই শক্তভাবে দাঁড়াবে, যখন নিজের সক্ষমতায় বিশ্বাস করবে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে এবং বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে জনগণের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করবে। চট্টগ্রাম বন্দর-সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে বিতর্ক তাই কেবল একটি চুক্তি নয়; এটি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির প্রশ্ন সম্পর্কিতও। এই নীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জাতীয় স্বার্থই সর্বাগ্রে থাকা উচিত।