ইতিহাসের যুগান্তকারী রায়

সম্পাদকীয়
১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৫
শেয়ার :
ইতিহাসের যুগান্তকারী রায়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল ১৭ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। একই অপরাধে সাবেক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকেও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলক। এই প্রথম একজন সরকারপ্রধানকে তাঁর কৃত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের বিচার শেষে দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড এবং একটিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজসাক্ষী হওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কমিয়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ে উঠে এসেছে জুলাইয়ের আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিত হামলা, গুলি করে হত্যা এবং দমন-পীড়নের বিস্তৃত ঘটনার বিবরণ। বিচারপ্রক্রিয়ার সময় উপস্থাপিত অডিও-ভিডিও প্রমাণ, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, জাতিসংঘসহ দেশ ও বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে আনীত অভিযোগের সত্যতাকেই প্রতিফলিত করেছে। সেই সময়ে সরকার ও দলের কতিপয় ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক ফোনালাপ আদালতে উপস্থাপন করা হয়- যার মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, মারণাস্ত্র ব্যবহার, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে সরাসরি গুলি করার নির্দেশেরও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সরকারপ্রধান হিসেবে সংঘটিত হত্যা ও নির্যাতনে সামগ্রিক দায় এড়াবার সূযোগও তাঁর নেই।

জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। প্রমাণিত হয়েছে, এদেশে আর জোর-জবরদস্তির শাসন চালু হবে না, কেউ আর বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে না। সর্বোপরি, এই রায় ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি।

উল্লেখ্য, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ’২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও পলাতক। কোনো সূত্রে জানা যায়, তিনিও ভারতে আছেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আলোকেই তাঁদের ফিরিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সরকার আবেদন জানালেও ভারত ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সঙ্গে বিষয়টির সুরাহা করা জরুরি।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কেবল শেখ হাসিনার বিচারই শেষ কথা নয়, তাঁর ১৬ বছরের শাসনামলে তাঁর অপকর্মের ভাগী ছিলেন অনেক রাজনীতিক, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ীসহ একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী; যাঁরা তাঁর অপকর্মের সমর্থন দিয়েছেন এবং বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন। আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে তাঁদেরও দ্রুত বিচার করতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যে, ভবিষ্যতে যেন আর দালাল গোষ্ঠী তৈরি না হয়। উল্লেখ্য, অপরাধীদের সামান্যই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। বড় অংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকে দেশে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। একাংশ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা ও দেশে ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এ রায় ঘোষণার পর পতিত স্বৈরাচার নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে, নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। নানা স্থানে হামলা ও আগুন লাগিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই অপশক্তির ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনকে আরও সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তথা জনগণের ঐক্য; যে ঐক্য জুলাই-আগস্টের রাজপথে গড়ে উঠেছিল, যে জাগরণ সেদিন তৈরি হয়েছিল, সেই ঐক্য ও জাগরণের শক্তি ধরে রাখতে হবে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সংস্কার ও নির্বাচনকে ঘিরে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ছোটখাটো ভেদাভেদ তৈরি হয়েছে- তা ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য বজায় রাখাই সময়ের দাবি।