সমন্বিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি

বাড়ছে অগ্নিসংযোগ-নাশকতা

সম্পাদকীয়
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮
শেয়ার :
সমন্বিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ, বোমা নিক্ষেপ, স্মৃতিস্তম্ভে হামলা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের শাখাগুলোয় ধারাবাহিক নাশকতার ঘটনা যে ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো সুসংগঠিত, পরিকল্পিত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার করে পরিচালিত সহিংস কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ঘোষণায় যত দৃঢ়ই শোনাক, মাঠপর্যায়ে সহিংসতার যে লাগাতার বিস্তার ঘটছে, তা সরকারের প্রতিরোধমূলক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের শাখাগুলোর বিরুদ্ধে উসকানি ছড়ানো হয়েছে প্রকাশ্যেই। নির্দিষ্ট ফেসবুক আইডি থেকে শাখার ঠিকানা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘বাকিটা আপনারা জানেন।’ এটি সরাসরি নাশকতার আহ্বান। এই ধরনের পোস্ট ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত থামাতে না পারা সরকারের ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতা। ফলও মিলেছে দ্রুত- ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় পেট্রোল ঢেলে আগুন, ককটেল নিক্ষেপ, জানালা ভাঙচুর- সবই ঘটেছে এক সপ্তাহের ব্যবধানে।

শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে হামলা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। পিরোজপুরে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে অগ্নিসংযোগ, বরগুনা ও পটুয়াখালীতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি- এগুলো শুধু সহিংসতা নয়, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক আক্রমণও বটে। স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে; পরে দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো- কেন আগে থেকে হুমকি মূল্যায়ন করা হলো না? কেন স্মৃতিস্তম্ভের মতো সংবেদনশীল স্থানে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো না?

উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেও দেরি চোখে পড়ে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে হামলার পোস্টগুলো কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়লেও উসকানিদাতাদের গ্রেপ্তার বা পোস্ট সরানোর উদ্যোগ যথাসময়ে দেখা যায়নি। অথচ একই সামাজিক মাধ্যম সরকার-সমর্থিত প্রচারণায় দ্রুত সক্রিয় হতে দেখা যায়।

পরিস্থিতির ভয়াবহ দিক হচ্ছে কিশোর-তরুণদের অপব্যবহার। মিরপুরে বাসে আগুন দেওয়ার সময় নদীতে পড়ে প্রাণ হারানো সাইয়াফ বা গ্রেপ্তার হওয়া সানি- দুজনই স্কুল-কলেজপড়ুয়া। পুলিশের দাবি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ‘পার্টি করার টাকা’ এবং পাঁচ হাজার টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আগুন দিতে পাঠিয়েছিলেন। এটি শুধু আইনগত অপরাধ নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়ার জঘন্যতম রাজনৈতিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।

কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা যে নতুন বিষয় নয়- তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রিপোর্টেই বহুবার উঠে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার রোধে সরকার এখনও কার্যকর কোনো কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অর্থের প্রলোভন, অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নজরদারির অভাব কিশোরদের দ্রুত অপরাধীচক্রে ঠেলে দেয়। এসব জানা থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে।

এ অবস্থায় রাষ্ট্র বলছে- বিশেষ অভিযান চলছে, প্রতিদিন এক হাজারের বেশি গ্রেপ্তার হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই ‘গ্রেপ্তারের সংখ্যা’ কি সত্যিই সহিংসতার উৎসে আঘাত করছে, নাকি শুধু পরিণতি সামলানো হচ্ছে? রাষ্ট্র যদি সত্যিই নাশকতা দমন করতে চাইত, তাহলে সামাজিক মাধ্যমে উসকানিদাতাদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় আগাম মোতায়েন, কিশোর অপরাধ রোধে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করত। গোয়েন্দা নজরদারির ঘাটতি পূরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমান কঠোরতা- এসবই ঘটত আগেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে ছুটছে ঘটনার পর, ব্যবস্থা নিচ্ছে ক্ষতির পর এবং অভিযান চালাচ্ছে সহিংসতার ঢেউ ওঠার পর। একটি সুসংগঠিত নাশকতামূলক পরিকল্পনার সামনে এমন প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান কার্যকর নয়। দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্র যথাসময়ে এবং যথাসম্ভব শক্তভাবে কাক্সিক্ষত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করেনি। সহিংসতা যখন এভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ এবং তাদের নিরাপত্তাবোধ। অস্থিতিশীল পরিবেশে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিনিয়োগ কমে, সামাজিক আস্থা ভেঙে পড়ে। আর সহিংসতার সংস্কৃতি যখন গড়ে ওঠে, তখন তা দীর্ঘমেয়াদে সমাজকে দুর্বল করে দেয়। এ কারণে এখন প্রয়োজন- রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও উসকানির সব পথ বন্ধ করে রাষ্ট্রের দৃঢ়, নিরপেক্ষ ও আগাম প্রতিরোধমূলক ভূমিকা। শুধু অভিযান নয়, বরং সহিংসতার মূল উৎস শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির নজির স্থাপন করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।