বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের বাহক

মিহির কুমার রায়
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৭
শেয়ার :
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের বাহক

কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ, পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব, যাকে এক কথায় বলা হয় নবান্ন ও বাঙালির প্রাণের উৎসব। একেবারে অনাদিকাল ধরে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে একই রীতি মেনে, দেশজুড়ে গ্রামের মতো নগরে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে। বর্তমানে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট চলছে, এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এবং উৎপাদন বাড়ানোর দৃঢ়প্রত্যয়ে এবার উদ্্যাপিত হয়েছে নবান্ন উৎসব ১৪৩২। অগ্রহায়ণ মানেই আমন ধান কাটার মাস, ফলন ও উৎপাদনে আমন বোরোর চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রতিবছর এর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। নবান্ন উৎসব তাই যথারীতি আনন্দঘন হচ্ছে যা ফলন বাড়িয়ে আনন্দকে আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা হবে বলেও প্রত্যাশা। এই ১ অগ্রহায়ণ দিনটি কৃষি দিবস হিসেবেও পালিত হচ্ছে।

নবান্ন মানে নতুন অনন্দ অর্থাৎ নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয় তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্্যাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো, ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন, বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এ ছাড়া নবান্ন উৎসবের দিন ‘গৃহস্থ’ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো যেমন- শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোনো কোনো বাড়িতে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবার সদস্যরা নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন, নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। অন্য একটি আচার অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়, তার চারপাশে পিটুলি দিয়ে আলপনা আঁকা হয়, এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়, সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলী, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন বিধায় এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। রাজধানী শহর ঢাকায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বেশ ঘটা করে বর্ণিল এ উৎসবের আয়োজন করা হয়, শহুরে শেকড়সন্ধানী সংস্কৃতিকর্মীরা লোক আঙ্গিকের গান-নাচ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন, চলে খই, মুড়ি, পিঠা-পুলির আয়োজনও।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ নানাভাবে নবান্নের মাস হেমন্তকে কবিতার ফ্রেমে প্রতিবিম্বিত করেছেন এক অনন্য রূপকল্প আর স্বপ্ন ও বাস্তব জগতের বিচিত্র বর্ণের রূপে। কবিতার মাধ্যমে জীবনানন্দ যে ছবি এঁকেছেন সে ছবি বাঙালি হৃদয়ে নবরূপে আবেগ, অনুভূতি এবং আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। একটি বিষয় ভেবে অবাক হই, গণমানুষের কবি, মানুষে মানুষে বৈষম্য দেখে যিনি কাতর হতেন সেই কিশোর কবি সুকান্তও হেমন্তের মোহে আবিষ্ট হয়েছিলেন। তার ‘এই নবান্নে’ পড়ে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আমরা যদি সত্যিকারভাবে দেশপ্রেমিক হই তাহলে আমাদের প্রকৃতিপ্রেমীও হতে হবে যা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নবান্নের মাস হেমন্তের গানে, কবিতায়, উপন্যাসে বর্ণনা করে গেছেন অনেক দিন আগে যা এখনও আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে রয়েছে। আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে রক্ষা করে একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে তুলি। নবান্নের উৎসবে সেটাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।

ড. মিহির কুমার রায় : গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা