অর্থায়ন ছাড়াই আর কত লড়বে উপকূল?

আল শাহারিয়া
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৮
শেয়ার :
অর্থায়ন ছাড়াই আর কত লড়বে উপকূল?

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। মানচিত্রে এটি একটি ভূখণ্ড মাত্র, কিন্তু বাস্তবে এটি এক প্রাত্যহিক রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনের একপাশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল রূপ সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা, মাটির লবণাক্ততা, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর তীব্র নদীভাঙন। অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে এই জনপদের লাখ লাখ নিঃস্ব মানুষ। এটি কোনো গতানুগতিক জীবনযাপন নয়। এটি একটি অঘোষিত জলবায়ুযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধারা হলেন আমাদের উপকূলের সেই অদম্য মানুষগুলো, যারা কোনো অপরাধ না করেও জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার।

প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে এই মানুষগুলোকে বেঁচে থাকার নতুন লড়াই শুরু করতে হয়। তাদের লড়াই সুপেয় পানির জন্য, তাদের লড়াই এক চিলতে ফসলি জমির জন্য, তাদের লড়াই ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বা বড় বড় সেমিনারে যখন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়, তখন এই মানুষগুলো সেই তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেন নিজেদের রক্ত, ঘাম এবং শেষ সম্বলটুকু দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ছাড়াই সম্পূর্ণ খালি হাতে তারা এই অসম লড়াই আর কতদিন চালিয়ে যাবেন? উপকূলের এই যোদ্ধারা লড়ছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে। যখন সমুদ্রের আগ্রাসী নোনাজল তাদের ফসলের মাঠ আর পুকুরের মিঠা পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে, তখন তারা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যে কৃষক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সোনালি ধান চাষ করতেন, তিনি আজ বাধ্য হয়ে লবণসহিষ্ণু জাতের ফসল আবাদের চেষ্টা করছেন, যা প্রায়ই অলাভজনক। অনেকে ধানের বদলে চিংড়ি চাষ শুরু করেছিলেন, কিন্তু সেই চিংড়ি ঘেরও ঘন ঘন দুর্যোগে ভেসে যাচ্ছে। যখন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়ছে, তখন তারা ধারদেনা করে বা শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ঘরের ভিটে এক ফুট উঁচু করছেন। এই ভিটে উঁচু করার প্রক্রিয়াটি কোনো সরকারি প্রকল্প নয়, এটি তাদের ব্যক্তিগত লড়াই। যে কৃষক একসময় জমিতে লাঙল চালাতেন, লবণাক্ততা তার জমি কেড়ে নেওয়ায় সে আজ পেশা পরিবর্তন করে নদীতে মাছ ধরছেন বা দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন।

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার কী, তা প্রতিফলিত হয় আমাদের জাতীয় বাজেটে। উপকূলীয় সুরক্ষা এবং অভিযোজনের জন্য প্রতিবছর যে বরাদ্দ রাখা হয়, তা কি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট?

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠিত হয়েছে, যা নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু মোকাবিলার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এই তহবিলের আকার এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল চাহিদা বিবেচনা করলে এই বরাদ্দকে অপ্রতুলই বলতে হয়। তদুপরি যেটুকু বরাদ্দ আসে, তা প্রায়ই ব্যয় হয় তাৎক্ষণিক বা জরুরি মেরামতের কাজে। টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে যে ধরনের বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার অভাব সুস্পষ্ট।

যখন একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়, তখন তা জরুরি মেরামত করা হয়। সেই দুর্বল বাঁধ পরের জলোচ্ছ্বাসেই আবার ভেঙে যায়। এই চক্রাকার ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে বরাদ্দের স্বল্পতা এবং সেই বরাদ্দের ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা ছাড়া কেবল খণ্ডিত প্রকল্প দিয়ে এই বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়। অর্থায়ন ছাড়া উপকূলের এই একতরফা লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ কী? এর পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এরই মধ্যে তা দেশব্যাপী দৃশ্যমান। সেই পরিণতি হলো- ব্যাপক হারে জলবায়ু অভিবাসন। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনার মতো বড় শহরগুলোর ওপর এই জলবায়ু শরণার্থীদের চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে কেবল শহরের নাগরিক সেবাই ভেঙে পড়ছে না, তৈরি হচ্ছে তীব্র সামাজিক অস্থিতিশীলতা, বাড়ছে অপরাধ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য। উপকূলের এই নীরব বিপর্যয় আজ আর কেবল দক্ষিণাঞ্চলের আঞ্চলিক সমস্যা নয়। এটি আজ সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে, উপকূলের জন্য জলবায়ু অর্থায়ন কোনো সহানুভূতি বা সাহায্য নয়। কারণ এই অর্থায়ন ছাড়া উপকূলের মানুষগুলোর এই অদম্য, একতরফা লড়াই একসময় থেমে যাবে। টিকে থাকার শেষ চেষ্টাও যখন ব্যর্থ হবে, তখন তারা রণে ভঙ্গ দেবে। আর সেই লড়াই থেমে গেলে তার পরিণতি একা উপকূলবাসী নয়, পুরো বাংলাদেশকেই ভোগ করতে হবে। উপকূলকে অরক্ষিত রেখে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা অসম্ভব।

আল শাহারিয়া : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর