ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রয়োজন
নারীর ওপর সহিংসতা ও অসম্মান
বাংলাদেশের নারী অগ্রযাত্রা দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, প্রশাসন- প্রতিটি জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে যে পরিবর্তন এনেছে, তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নচিত্রকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই অর্জন এখন নতুন করে এক ধরনের সামাজিক ও আদর্শগত চাপের মুখে পড়েছে। কোথাও ধর্মীয় ব্যাখ্যার নামে, কোথাও নৈতিকতার যুক্তি দেখিয়ে নারীদের ঘরের ভেতরে বন্দি করার প্রবণতা বাড়ছে। কাজের সময় কমানো, কর্মক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতিকে সীমিত করা কিংবা সামাজিকভাবে তাদের ভূমিকা সংকুচিত করার প্রস্তাবগুলো শুধু নারীর স্বাধীনতাকে খর্বই করছে না, বরং সমগ্র জাতির অগ্রগতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শাহবাগে ‘নারীর ওপর সহিংসতা ও অসম্মান : প্রতিরোধে প্রস্তুত সচেতন নারী সমাজ’ শীর্ষক মৌন মিছিল ও সমাবেশে বিএনপির উপস্থিতি ও বক্তব্য নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট অবস্থান তৈরি করেছে। সেখানে বিএনপির নেতারা যেভাবে নারীদের ঘরে বন্দি করার প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন এবং ধর্ষণ, গুম-খুন, নির্যাতনের বাড়তি ঘটনাগুলো তুলে ধরে বলেছেন যে, নারীকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে- এটি রাজনৈতিকভাবে একটি প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ। নারীর কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবকে তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু শহরেই নয়- বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান অপরিসীম। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষিশ্রমিক, পোশাকশিল্পের শ্রমিক, এনজিওকর্মী- প্রায় প্রতিটি খাতেই নারীর শ্রম পরিবার ও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের কর্মঘণ্টা বা কর্মক্ষেত্র সীমিত করার যে ধারণা সামনে আনা হচ্ছে, তা শুধুই বৈষম্যমূলক নয়, জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনারও পরিপন্থি।
মূলত বাংলাদেশে নারীর ওপর সহিংসতার চিত্রও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, গুম-খুন, পারিবারিক নির্যাতন- এসব অপরাধ আমাদের সমাজে যেন স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। শিশুরাও এর বাইরে নেই। বিচারহীনতার কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হচ্ছে। যে পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের আশায় তাকিয়ে থাকে, তারা হতাশ হয় যখন দেখে যে আইনি প্রক্রিয়া ধীর, ভিকটিমের নিরাপত্তা নেই, আর সমাজের একটি অংশ অপরাধীদের পক্ষ নেয়। এই হতাশা শুধু ভুক্তভোগীকে নয়, পুরো জাতিকে আঘাত করে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এ অবস্থায় আমাদের মনে রাখতে হবে, জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল বৈষম্য দূর করা এবং সব নাগরিকের জন্য সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা। সেই পরিবর্তনের চেতনা ছিল- রাষ্ট্র কোনোভাবেই নাগরিকের লিঙ্গ, ধর্ম, জন্ম, পেশা বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য বজায় রাখবে না। বরং সমতা ও মানবাধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যেখানে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদায় এগিয়ে যাবে। কিন্তু নারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা এই অঙ্গীকার থেকে বিপজ্জনকভাবে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। রাষ্ট্র যদি আবারও বৈষম্যকে অনুমোদন করে বা নীরব থাকে, তাহলে এই সমাজকে পরিবর্তনের যে স্বপ্ন জনগণ দেখেছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
জুলাইয়ের আন্দোলন দেখিয়েছিল- নাগরিকরা বৈষম্য ও দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে জানে। একটি সমাজ তখনই টেকসই উন্নয়নের পথে এগোয়, যখন নারীকে সমান তালে সামনে এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়। নারীদের ঘরে আটকে রাখা মানে শুধু তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয়, বরং পরিবার, রাষ্ট্র এবং অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেওয়া। একটি দেশে দারিদ্র্য কমাতে চাইলে নারীর আয়শক্তি অপরিহার্য। সামাজিক সহনশীলতা চাইলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। আর একটি দেশে গণতন্ত্র চাইলে অবশ্যই নারীর মতপ্রকাশ, কর্মসংস্থান ও চলাচলের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে হয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে- এখনই সেই সিদ্ধান্তের সময়। নারীর অধিকার রক্ষা করা রাজনৈতিক লাভক্ষতির বিষয় নয়; এটি মানবিক ন্যায়, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক শর্ত। নারীদের ঘরে বন্দি করার প্রবণতার বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক ও নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, সেটি আরও বিস্তৃত করতে হবে। কারণ যে জাতি নারীর স্বাধীনতা অস্বীকার করে, সে জাতি কোনোদিন সমান মর্যাদার সমাজ গড়তে পারে না।