শীতে বিপর্যস্ত প্রান্তিক জনজীবন

সুমাইয়া সিরাজ সিমি
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫১
শেয়ার :
শীতে বিপর্যস্ত প্রান্তিক জনজীবন

বাংলাদেশের ঋতুচক্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ শীতকাল। ঋতুটি কারও ভীষণ পছন্দের ও কারও জন্য অভিশাপের। আবহাওয়ার পালাবদলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে, যেমন পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী- এই জেলাগুলোতে শীতের তীব্রতা অনুভূত হয় সর্বাধিক। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসজুড়ে এই তীব্রতা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বিরাজ করে। এই সময়ে প্রকৃতির এমন রুক্ষতা যখন বিত্তশালীদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ, তখন দেশের বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে তা নেমে আসে এক কঠিন অভিশাপ হয়ে।

শীতকাল মানেই ঠাণ্ডাজনিত রোগের ব্যাপক বিস্তার। প্রান্তিক জনজীবনে এর প্রকোপ বহুগুণ বেশি। এই সময়ে সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট এবং ডায়রিয়াসহ নানা জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা, এরপরই আসে বৃদ্ধ ও নারীরা।

চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজনের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। সামান্য চিকিৎসা খরচ মেটানোর সামর্থ্য যাদের নেই, দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই যাদের দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, তাদের পক্ষে শীত থেকে বাঁচতে উন্নতমানের গরম পোশাক পরিধান করা কিংবা রোগের সঠিক চিকিৎসা করানো প্রায় অসম্ভব। অভাবের তাড়নায় বহু বাবা-মা তাদের শিশুদের জন্য ন্যূনতম শীতবস্ত্রের জোগান দিতে পারেন না। ফলে শিশুরা সহজেই ঠাণ্ডার শিকার হয় এবং মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসা জুটলেও, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এখনও উন্নত চিকিৎসাসেবার ঘাটতি প্রকট। স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং মানসম্পন্ন ওষুধের অপ্রতুলতা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার প্রধান অন্তরায়। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে গিয়ে বেসরকারি বা মানসম্মত চিকিৎসা নেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। ফলে অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়ে মানহীন বা হাতুড়ে চিকিৎসার দ্বারস্থ হন, যা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধদের অবস্থাও শোচনীয়। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বয়োজ্যেষ্ঠরা ঠাণ্ডাজনিত নানান জটিলতায় ভুগতে থাকেন। যে সমাজে নবপ্রস্ফুটিত শিশুরাই ভালো চিকিৎসা পায় না, সেখানে বয়স্করা কীভাবে পাবেন? দুঃখজনক হলেও সত্য, শীতকালে প্রান্তিক জনপদে বৃদ্ধদের মৃত্যুর হারও বেড়ে যায়, যা রাষ্ট্রের দুর্বল স্বাস্থ্য কাঠামোর একটি মর্মান্তিক প্রতিফলন।

শীতের তীব্রতা প্রান্তিক জনজীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দেয়। কুয়াশার চাদরে যখন চারদিক ঢাকা, তখনই জীবিকার টানে মানুষগুলো বেরিয়ে পড়ে। খেটে খাওয়া শ্রমিকরা খুব ভোরে হালকা আগুনের উষ্ণতা শরীরে মেখে রওনা হন কাজের উদ্দেশ্যে। কৃষক ভোর না হতেই চলে যান জমিতে, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় কাজ করেন ফসলের মাঠে।

শীতকালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারি উদ্যোগে শীতবস্ত্র (কম্বল) এবং ক্ষেত্রবিশেষে নগদ অর্থ বা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বাস্তবে এর সফলতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে।

কম্বল ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা এবং বিতরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সমাজের বিত্তশালীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রান্তিক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

যদি দ্রুত এই বৈষম্য নিরসন করা না যায়, তবে প্রতিবছরই আমরা শীতকালে এমন করুণ দৃশ্য দেখতে পাব- যা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চিত্র নয়, বরং রাষ্ট্রের পরিকল্পনার অভাব ও বৈষম্যমূলক নীতির ফল। টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। শুধু তখনই উন্নয়নের আলো দেশের প্রতিটি কোণে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে, যখন প্রান্তিক মানুষের দুঃখ কমে আসতে শুরু করবে। রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর অংশের উচিত এই প্রান্তিক মানুষের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া। শুধু মানবিক আবেদন নয়, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রের উচিত এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা।


সুমাইয়া সিরাজ সিমি : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়