নুন আনতে পান্তা ফুরোয় নুনদাতাদের

নাহিদ হাসান
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪০
শেয়ার :
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় নুনদাতাদের

নুন আনতে পানতে ফুরোয় কথাটার সঙ্গে সবার পরিচয় আছে। সেই নুনের দাম ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের বছর ৫০ পয়সা কেজি থেকে এক লাফে ৪০ টাকায় উঠেছিল। মানুষ লবণের বদলে চিনি খেয়েছে নাকি। লুঙ্গির গিঁড়ায় লবণ কিনে আনত।

এর গুরুগম্ভীর শাস্ত্রীয় নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। তৈরি হয় কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত সমুদ্রের পানি উড়িয়ে দিয়ে। ফলে পাওয়াও যায় তা অঢেল পরিমাণে। নুনের দেশে নুন মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেও মুদির দোকানিরা রাতেও নুনের বস্তা বাইরেই ফেলে রাখত। ১৯৩৯ সালের মডার্ন রিভিউতে জে কে নাগ বলেছেন, নবাবি আমলে এই শিল্পের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে জলেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বর্গমাইলজুড়ে ছড়ানো ছিল লবণশিল্প। অঞ্চলগুলোর নাম ছিল নুনদ্বীপ। এই শিল্প গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধরনের কারিগর, ব্যবসায়ী, জমিদার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সক্রিয় সহযোগে দীর্ঘকালের চেষ্টায়। চট্টগ্রামে দুই ধরনের লবণ উৎপাদিত হতো, জাট ও তেলিনিয়া। উৎপন্ন লবণের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ছিল জাট লবণ, আর চার ভাগের এক ভাগ ছিল তেলিনিয়া। স্বচ্ছতায়, শুভ্রতায়, গুণমানে তেলিনিয়া লবণ, জাট লবণের চেয়ে অনেক উন্নতমানের ছিল।

বাইরের জেলা থেকে আসা মালঙ্গীরা জাটের লবণ তৈরি করত। তেলিনিয়া লবণ শুধু কর্ণফুলী নদীর উত্তরে চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে বসবাস করা মালঙ্গীরাই তৈরি করত। বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সাধিত হতো প্রচুর পরিমাণে হাট বা গ্রামের বাজার নির্ভর করে। পুরো চট্টগ্রাম জেলার প্রতি ৮ থেকে ১০ কিমি. অন্তত একটা না একটা হাট/বাজার/গঞ্জের সন্ধান পাওয়া যেত। প্রত্যেকটির অবস্থান এতই সুবিধাজনকভাবে ছিল যে, প্রতিটি গ্রামই কোনো না কোনো হাট/বাজার/গঞ্জ থেকে দূরে ছিল না। এলাকার উৎপাদিত দ্রব্য বহন করত কুলি অথবা চাষিরা নিজেরাই তাদের পণ্য নিকটতম বাজারে নিয়ে আসত। আরেকটি উৎস হলো, সৈন্ধব লবণ (বা হিমালয়ান রক সল্ট), সামুদ্রিক করকচ নুন, কালো নুন বা খনিজ নুন- এসবই হলো সুস্বাস্থের জন্য প্রকৃতির ভাণ্ডার, যাতে ৭২ থেকে ৮০ প্রকার খনিজ প্রাকৃতিকভাবেই সুষম আকারে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু অংশে লবণ পাওয়া যেত। পাহাড়ের অনেক জায়গায় লবণ-পিট পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিচিত স্থানটার নাম ছিল উত্তরে ভাঙ্গামুরা এবং জেলার পূর্ব অংশে মাওদাং ক্লাং। দুটি লবণ ঝরনার ছিল, দুটোরই ছিল ঠাণ্ডা প্রবাহ। এ ছাড়া তৃতীয় ঝরনা ছিল। কুকি সমাজ সমতল অগ্নিকুণ্ডের ওপর সারিবদ্ধভাবে সাজানো তিন কোনা আকৃতির মাটির পাত্রে স্থানীয় ঝরনার জল ফুটিয়ে লবণ তৈরি করত। লবণের রঙ ছিল হাল্কা ধূসর। পাহাড়ি স্থানীয় জাতি শেন্দুরাও একইভাবে ঝরনার জল ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন করত।

দুই.

১৯৮৬ সাল। গুজরাটে টাটা কেমিক্যালসের একটা বিশাল কারখানা। সেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সহ-উৎপাদিত বর্জ্য হিসেবে টন টন রাসায়নিক নুন বেরিয়ে আসত। এই বর্জ্য কৃষিজমি নষ্ট করবে। তাই সমুদ্রতীর পর্যন্ত রেললাইন বসিয়ে সমুদ্রে নিয়ে ফেলে আসতে হতো এই নুন। বর্জ্য ফেলার এই বিপুল ব্যয় থেকে নিষ্কৃতি পেতেই এই পরিকল্পনা। এতে বোঝা হয়ে গেল মুনাফার উৎস।

টাটা গোষ্ঠী রাজীব গান্ধী পরিচালিত সরকারের কাছে ধরনা দিল আয়োডিনযুক্ত লবণ বিক্রি করার অনুমতি চেয়ে। অজুহাত ছিল এই যে, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে মানুষ আয়োডিনের অভাবজনিত অসুখে ভোগে, তাই আয়োডিনযুক্ত লবণ জরুরি। প্রয়াস সফল হলো। গান্ধী সরকার প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আয়োডিনযুক্ত নুনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দিল। ফলে টাটা অবিলম্বে বাজারের একচেটিয়া দখল নিল।- ‘টাটা নিমক, দেশ কা নিমক।’

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দেখলেন, আরে দারুণ তো! লবণ যেখানে সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে বস্তায় ভরে সস্তায় ভোক্তার কাছে যায়, আয়োডিনের কথা বলে মাঝখানে তারা ঢুকতে পারেন। এবার মোল্লা, এসিআই নামের লবণের প্যাকেটে হাট-বাজার ছেয়ে গেল। আইন হলো, আয়োডিনমুক্ত লবণ বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ। কৃষকরা এখন কোম্পানিগুলোর কাছে লবণ বিক্রি করতে বাধ্য। ফলে কৃষক কম দামে লবণ বেচতে বাধ্য হলেন আর উল্টোদিকে ভোক্তারা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হলো।

তিন.

এখন উৎপাদনের খরচের তুলনায় লবণের দাম অনেক কম। প্রতি মণে ৪০ কেজি হলেও লবণ চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণে ৬০ কেজি লবণ নেয় মহাজনরা। সরকারিভাবে কোনো মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি এবং তদারকিও নেই।

অন্যদিকে বর্গাচাষিদের বাজারদর থেকে মণপ্রতি ১০০ টাকা কম দেওয়া হয়। পাশাপাশি লবণের দাম বাড়লে মহাজনরা বিক্রি বন্ধ রাখে। আর দাম কমলে বর্গাচাষিদের কাছ থেকে তারা লবণ কিনে রাখে। ইচ্ছেমতো জমির ভাড়া আদায় করা হয়। এবং দালাল ছাড়া কেনে না মিল মালিকরা। এখানে কোনো সরকার নেই।

১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা বা লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হয়। এই সত্যাগ্রহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লবণ পদযাত্রা ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণনীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস কর প্রদানবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। কিন্তু সেই লবণ চাষিদের এখন টেকসই কোনো সংগঠন নেই। এত বড় অভ্যুত্থান হলো, লবণ চাষিদের নিয়ে কিছু শুনেছেন? মানুষ তো তখনই স্বাধীন, যখন তারা তাদের কাজ ও সম্পদ নিজের মতো করে পরিচালনা করতে পারে এবং ইচ্ছেমতো জীবনের পথ বেছে নিতে পারে। কত মধুমাখা বুলি শুনছি কিন্তু পারছে কি?


নাহিদ হাসান : লেখক ও সংগঠক

মতামত লেখকের নিজস্ব