জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে
আস্থাহীনতায় বীমা খাত
বাংলাদেশের বীমা খাত দীর্ঘদিন ধরেই সম্ভাবনাময় একটি আর্থিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা- এসব ক্ষেত্রে বীমা খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বাস্তবে এ খাতটি এখন আস্থাহীনতার গভীর সংকটে নিমজ্জিত। অনিয়ম ও অনিয়ন্ত্রণ, বীমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি ও জালিয়াতি, দাবি পরিশোধে গড়িমসি, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা ইত্যাদি কারণে বীমা খাতের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়েছে। ফলে বীমা খাতে নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পলিসি বিক্রি কমছে, গ্রাহক হ্রাস পাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে, আর সাধারণ মানুষ বীমার নাম শুনলেই দূরে সরে যাচ্ছে।
গত আড়াই বছরের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সক্রিয় জীবন বীমা পলিসি কমেছে ১০ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি- যা মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশের বেশি। পলিসি ধরে রাখার পরিবর্তে গ্রাহকরা একের পর এক সরে যাচ্ছেন। কারণ একটাই- আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। যে খাতের মূল ভিত্তিই আস্থা, সেটি যখন দুর্বল হয়, তখন অন্য সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়।
এই আস্থাহীনতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা, অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাব। গ্রাহকরা বছরের পর বছর নিজের টাকা পাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেন, কিন্তু নিশ্চয়তা মেলে না। আইডিআরএর হিসাব বলছে, বর্তমানে বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকারও বেশি। অন্যদিকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে হাজার কোটি টাকা তহবিল আত্মসাৎ হয়েছে- ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, সোনালী লাইফ ও হোমল্যান্ড লাইফের মতো কোম্পানিতে মিলছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি অনিয়মের প্রমাণ। অর্থ আত্মসাৎকারীরা সুযোগ বুঝে আইনের দুর্বলতা ব্যবহার করেছে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ গ্রাহক। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর সীমাবদ্ধতাও প্রকট। অভিযোগের পাহাড় জমলেও কার্যকর পদক্ষেপ কম। তত্ত্বাবধান দুর্বল, মামলার নিষ্পত্তি ধীর, আর প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ছাড়া বীমা খাত কখনই টেকসই হতে পারে না। গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে আইডিআরএকে নিজেকেই আগে আস্থার জায়গায় দাঁড়াতে হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলেছেন- বিশ্বাসই বীমা খাতের প্রাণ। কিন্তু অর্থনীতিতে এত বেশি বীমা কোম্পানি থাকা নিজেই সমস্যা তৈরি করছে। বীমা ব্যবসা যেন গ্রাহকের সেবার জায়গা থেকে সরে কেবল মালিকপক্ষের লাভের উপাদানে পরিণত হয়েছিল। এখন সেজন্য গ্রাহকদের আস্থা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে- বকেয়া দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির নিশ্চয়তা করতে হবে। তহবিল ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি করা খুবই প্রয়োজন। আইডিআরএর সক্ষমতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বচ্ছ তথ্যপ্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রাহকবান্ধব সেবা ও পলিসির শর্ত সহজীকরণ এবং এজেন্টদের দক্ষতা ও নৈতিকতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা। এতে শুধু শাস্তি নয়, পুরো খাতের জন্য একটি বার্তাও যাবে- বীমা খাতে নিরাপদ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জীবন বীমা খাত বাংলাদেশের আর্থিক খাতের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হতে পারত। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে সেই সম্ভাবনা আজ বিপন্ন। আস্থা ফিরে না এলে এই খাতের পুনরুদ্ধার অসম্ভব। মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, তাদের টাকা নিরাপদ, দাবি যথাসময়ে পরিশোধ হবে, আর একটি বীমা পলিসি সত্যিই পরিবারের জন্য নিরাপত্তা বয়ে আনতে পারে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এখন সময় এসেছে বীমা খাতের আস্থার সংকট নিরসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার। বিশেষ করে আস্থাহীনতা দূর করতে হলে বীমা কোম্পানিগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। বীমা গ্রাহকদের অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বীমা আইন ও বিধি সংশোধন করে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে এই খাত কখনই তার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই এখনই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করি, এ অবস্থার উত্তরণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।