সংস্কৃতির নতুন ভোর
রাত ঘনিয়ে আসে, আলো নিভে যায় ধীরে ধীরে। মঞ্চের পর্দা নামতেই গ্যালারিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সময়। এরপর যখন আলোর বৃত্তে দেখা মেলে চরিত্রের তখনই যেন এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হয় দর্শকের চোখে। সেই পৃথিবীই মঞ্চনাটকের জগৎ যেখানে কল্পনা আর বাস্তবতার সীমানা মিশে যায় একাকার হয়ে। কিন্তু সময়ের প্রবল স্রোতে এই শিল্পরূপ একসময় হারিয়ে যেতে বসেছিল দর্শকের মন থেকে। এখন আবার দেখা যাচ্ছে তার ধীরে ধীরে ফিরে আসা- এ যেন এক নিঃশব্দ তবু উজ্জ্বল পুনর্জন্মের গল্প।
আমাদের ওই ভারতীয় উপমহাদেশে মঞ্চনাটকের আগমন ঘটে ১৭৯৫ সালে, যখন রুশ নাগরিক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ কলকাতায় প্রথম বাংলা মঞ্চনাটক ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ স্থাপন করেন। ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রথম বাঙালি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আরও অনেক মঞ্চ নাট্যদল গড়ে ওঠে এবং চলচ্চিত্রের প্রভাবে এর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমলেও বিভিন্ন সময়ে এর বিবর্তন ঘটেছে।
এরপর বাংলাদেশে আধুনিক অর্থে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত মঞ্চনাটকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, এরপর আরণ্যক বিবর্তন, থিয়েটার, অনুশীলন, প্রতিধ্বনি, বাঁশরীসহ অসংখ্য দল শহর-গ্রামজুড়ে নাটকের এক নবজোয়ার সৃষ্টি করে। নূরুলদীনের ‘সারাজীবন’, ‘কবর’, ‘এখনও দণ্ডায়মান’, ‘চিরঞ্জীব মুনিরা’, ‘পুতুল খেলা’ এসব নাটক শুধু গল্প নয়, ছিল সময়ের প্রতিবাদ। সেই সময় ঢাকার বেইলি রোডের নাটক সরণি ছিল এক সাংস্কৃতিক মহাযজ্ঞের কেন্দ্র। দর্শকরা সন্ধ্যায় টিকিট কিনে লাইন ধরতেন নাটক দেখার জন্য। মঞ্চনাটক তখন শহরের প্রাণের স্পন্দন ছিল।
তবে নব্বইয়ের পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে যায় চিত্র। ডিজিটাল যুগে টেলিভিশন এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের (ঙঞঞ) উত্থানের কারণে মঞ্চনাটক এখন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে। সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়েছে।? তবে মঞ্চনাটকের একটি আবেদন এখনও টিকে আছে। শিল্পকলা একাডেমি বা অন্যান্য মঞ্চে নিয়মিত প্রদর্শনীতে এখনও নাটকপ্রেমী ও সচেতন দর্শক ভিড় করেন। নতুন নাটকের দলও তৈরি হচ্ছে।? মঞ্চনাটক এখনও সমাজ ও সংস্কৃতির দর্পণ হিসেবে তার গুরুত্ব ধরে রেখেছে। সামাজিক সমস্যা ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২০০০-এর দশকে শুরু হয় এক নতুন যুগ। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক নাট্য সংগঠন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার, চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট- তারা আবার ফিরিয়ে আনে তরুণ প্রজন্মকে মঞ্চের আলোয়। নাট্যোৎসব, কর্মশালা ও মঞ্চমুখী নাট্যচর্চা ধীরে ধীরে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। তরুণ নির্মাতারা আধুনিক প্রযুক্তি ডিজিটাল আলো প্রজেকশন আর মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে গল্প বলছেন ভিন্নভাবে। দর্শকও নতুন আঙ্গিকে নাটক দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ‘গ্যালিলিও’, ‘রক্তকরবী’ বা ‘অবলোমন’-এর নতুন ব্যাখ্যা তরুণদের ভাবিয়ে তুলছে, সংবেদনশীল করে তুলছে।
আজকের নাট্যচর্চা শুধু বড় মঞ্চে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় নাট্যদল নিয়মিত প্রযোজনা করছে। এছাড়া এখন চলছে কমিউনিটি থিয়েটার আন্দোলন, যেখানে গ্রামের সাধারণ মানুষও অংশ নিচ্ছেন নাটকে। অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রমোশন চালিয়ে নাটকের প্রতি আগ্রহ জাগাচ্ছেন তরুণদের মধ্যে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বার্ষিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারাদেশে প্রায় ৭০০টির বেশি নাট্যপ্রদর্শনী হয়েছে যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটি মঞ্চনাটকের পুনর্জাগরণেরই প্রতীক।
তাই বলা যায়, নাটক কোনো বিনোদনের পরিসর নয়- এটি এক সামাজিক বিবেক। যখন মানুষ অন্যায় দেখেও চুপ থাকে তখন নাটকের মঞ্চে সেই প্রতিবাদ উচ্চারিত হয় সংলাপেব মুখোশে সুরে। তাই আজ যখন তরুণরা আবার মঞ্চে ফিরে আসছে তখন দর্শক আবার ভিড় জমাচ্ছে নাট্যোৎসবে তখন বোঝা যায় মঞ্চনাটক আবার বেঁচে উঠছে নতুন আঙ্গিকে নতুন দর্শকের হাত ধরে। এই পুনর্জন্ম কেবল নাটকের নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিরও নতুন ভোর।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মো. আল আমিন হোসাইন : শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা