বিশ্বাস ফেরাতে চাই কঠোর পদক্ষেপ
দুদকে জনবল নিয়োগে প্রতারণা
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’। সেই প্রবাদটিই যেন হুবহু খাটে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষেত্রে। দেশের দুর্নীতি দমন ও সততা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যার কাঁধে, সেই সংস্থার নিয়োগ প্রক্রিয়াই এখন তদবির ও প্রতারণার ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়েছে।
দুদকে বর্তমানে সহকারী ও উপসহকারী পরিচালক, কনস্টেবল, অফিস সহায়কসহ বিভিন্ন পদে ১৮৬ জন নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এসব পদে কয়েক লাখ প্রার্থী আবেদন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এমন বড় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আগ্রহ থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়া ঘিরে তদবির ও প্রতারণার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
সম্প্রতি ‘জেনারেল আকবর’ পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাফতুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি, যিনি নাকি প্রার্থীদের কাছ থেকে কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। অবশ্য দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। সেটি অবশ্যই ইতিবাচক উদ্যোগ।
আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া যে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়, তা কেবল একটি দাপ্তরিক দাবি। বাস্তবে হাজার হাজার প্রার্থীর মাঝে অস্বচ্ছতা, গুজব, তদবির ও প্রভাবের সুযোগ থেকেই প্রতারণার জন্ম হয়। সরকারি চাকরির প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ এবং ‘চাকরি পেতে হলে চেনাজানার দরকার’- এই মানসিকতা প্রতারকদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। তা ছাড়া প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- যদি নিয়োগ প্রক্রিয়া সত্যিই এতটা স্বচ্ছ হয়, তবে প্রতারকচক্রগুলো কীভাবে প্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারছে? কে বা কারা এসব প্রতারণার সুযোগ তৈরি করছে?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সমস্যার মূল আসলে দুদকের বাইরের প্রতারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর পেছনে কাজ করছে একটি সংস্কৃতি- ‘চাকরি পেতে তদবির বা ঘুষ লাগে।’ প্রতিটি সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যখন দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়, তখন দুদকের দায় দ্বিগুণ- একদিকে নিজেকে সৎ প্রমাণ করা, অন্যদিকে অন্য প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দমন করা। কিন্তু যদি নিজেদের ঘরেই অনিয়মের গন্ধ ওঠে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোন নৈতিক ভিত্তিতে দুদকের ওপর আস্থা রাখবে?
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম শুধু দুদকের প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, নৈতিক ব্যর্থতাও বটে। ‘চাকরির জন্য তদবিরই অযোগ্যতা’- এই নীতিকে যদি সত্যিই বাস্তবে রূপ দিতে হয়, তাহলে প্রথমে দুদকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাকেই স্বচ্ছ করতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মূল্যায়ন, মৌখিক সাক্ষাৎকার, এমনকি প্রশাসনিক তদারকিতেও ডিজিটাল নজরদারি বাড়ানো জরুরি। স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে প্রযুক্তিনির্ভর না করলে কাগজে-কলমে স্বচ্ছতা বজায় রেখে বাস্তবে অনিয়ম ঠেকানো সম্ভব হবে না।
এ ছাড়া প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে নজরদারি আরও শক্ত করতে হবে। যারা দুদকের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রার্থীদেরও সচেতন থাকতে হবে- কোনোভাবেই আর্থিক লেনদেনে জড়ানো মানেই নিজের যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দুদকের বর্তমান নেতৃত্বের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজেদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো দেশের দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই এখনই সময়, দুদককে প্রমাণ করতে হবে যে তাদের অভ্যন্তরে কোনো অসততা নেই। স্বচ্ছ, একমাত্র যোগ্যতাভিত্তিক এবং ন্যায়নিষ্ঠ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুদকই পারে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে- যা ভবিষ্যতে গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্যও হবে এক ইতিবাচক বার্তা।
সবশেষে বলা যায়, দুদকের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে প্রতারণার ঘটনা শুধু কিছু অসাধু ব্যক্তির অপরাধ নয়, বরং এটি আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত ত্রুটির প্রতিফলন। এই ত্রুটি না মুছে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়া সম্ভব নয়। দুদককে তার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রথমেই নিজের ভেতরের ‘ভূত’ তাড়াতে হবে। নচেৎ দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে সংস্থাটিই পরিণত হবে দুর্নীতির আরেক আশ্রয়স্থলে- যেখানে ন্যায়বিচারের বদলে প্রভাব, আর সততার বদলে তদবির রাজত্ব করবে।