আন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ

তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব : দাউদ ইব্রাহিম হাসান
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৯
শেয়ার :
আন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ

যোগাযোগ, যে মাধ্যমেই হোক না কেন, সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। আন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শুধু ভৌগোলিক দূরত্বই কমায় না, এটি মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও নিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎ সুবিধাগুলো যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক সড়ক সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক লজিস্টিক হাব হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর (ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার) সঙ্গে বাণিজ্য ও যাতায়াত বহুগুণ সহজ হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে আরও শক্তিশালী করবে।

কিন্তু এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু ঘোর বিপদ। এত দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা বাড়তে পারে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যে নদীগুলো একসময় দেশের প্রাণ ছিল, যে উর্বর ভূমি ছিল কৃষকের অবলম্বন, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। আঞ্চলিক সংযোগে সুরক্ষা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। চোরাচালান, মানবপাচার এবং সীমান্ত সংঘাতের মতো বিষয়গুলো এই সংযোগের সুফলকে ম্লান করে দিতে পারে। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ জনবলের অভাব সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদি আমরা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে না পারি, তবে আধুনিকতার এই ধারাটি নিজেই একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই সমস্যাগুলো যেন সমাজের উন্নতির পথে এক অদৃশ্য শোষণ হয়ে কাজ করছে, যা দেশের প্রকৃত সম্ভাবনাকে আটকে রাখছে।

আন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের এই জটিল কাঠামো কেবল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এটি আমাদের সামগ্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আব্দুল সাহেবের চায়ের দোকানে প্রবীণদের আলোচনার বিষয় ‘দেশের উন্নয়ন’ আজ আর সরকারের একক দায়িত্ব নয়; এটি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। যেমন, ভিয়েতনামের পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. ফাম খ্যাং ল্যাম তার গবেষণায় পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে নগর উন্নয়নের মডেল উপস্থাপন করেছেন। ঠিক তেমনি, বাংলাদেশেও দূরদর্শী নেতৃত্ব ও কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কৌশল নির্ধারণ করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং কাস্টমস প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব। এভাবে বাংলাদেশ কেবল তার ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা নয়, বরং দক্ষ জনবল ও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও কার্যকর নেতৃত্বের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে গঠন করা যাবে এক নতুন বাংলাদেশ।

আন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের এই জটিল জাল বুনন কেবল প্রকৌশলগত এক চ্যালেঞ্জ নয়, এটি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘দেশের উন্নতি’ আজ কেবল সরকারের একার দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা, সমন্বিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে পরিবেশগত ক্ষতি কমানো এবং আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলোকে আরও সহজ করা ও কাস্টমস প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ- এই পদক্ষেপগুলো আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে। বাংলাদেশ কেবল ভৌগোলিক অবস্থানেই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও একটি আঞ্চলিক হাব হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যাগুলো অতিক্রম করা সম্ভব।

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব : সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

দাউদ ইব্রাহিম হাসান : রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়