ডায়াবেটিসের বর্তমান পরিস্থিতি ও উন্নয়নের উপায়
প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয় ইনসুলিনের আবিষ্কারক স্যার ফ্রেডরিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিনকে স্মরণ করে। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘Diabetes and the Workplace’, অর্থাৎ ‘কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন এবং পদক্ষেপ নিন।’ এ বছরের মূল লক্ষ্য হলো কর্মজীবী মানুষ ও নিয়োগদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যেন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা কর্মস্থলে বৈষম্য, স্ট্রেস বা অজ্ঞতার শিকার না হন এবং সবাই মিলে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারেন।
এ উপলক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান ডায়াবেটিস পরিস্থিতি এবং এর উন্নয়নের উপায় নিয়ে ভাবা অত্যন্ত জরুরি। কারণ ডায়াবেটিস এখন আর কেবল শহরের ধনী মানুষের রোগ নয়- এটি গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব বিপর্যয়ে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের বর্তমান চিত্র
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (IDF)-এর ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ১ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম সর্বোচ্চ। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ২ কোটিরও বেশি হতে পারে।
দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যার মধ্যে পুরুষদের হার নারীদের তুলনায় কিছুটা বেশি। শহরাঞ্চলে আক্রান্তের হার ১৬-১৮%, তবে দ্রুত নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার অস্বাস্থ্যকর ধারা গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি করছে।
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় টাইপ-২ ডায়াবেটিস, যা জীবনধারাজনিত। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এখন অনেক তরুণ ও মধ্যবয়সী মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদনক্ষম বয়সে নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ নিজের রোগ সম্পর্কে জানেন না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০% রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও তা শনাক্ত হয়নি। ফলে জটিলতা দেখা না দেওয়া পর্যন্ত তারা চিকিৎসা নেন না। এই জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, কিডনি বিকলতা, চোখের রেটিনার সমস্যা, স্নায়ুক্ষয় এবং পায়ের ঘা ইত্যাদি।
ডায়াবেটিসের কারণে ব্যক্তিগত ও জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে ওষুধ, ইনসুলিন, চিকিৎসা ও পরীক্ষার খরচ; অন্যদিকে কর্মক্ষমতা হ্রাস, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং অকালমৃত্যু- সব মিলিয়ে এটি একটি বিশাল আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস মোকাবিলায় অনেক অগ্রগতি হলেও এখনও কিছু বড় বাধা রয়ে গেছে-
১. সচেতনতার অভাব : অনেকেই এখনও মনে করেন ডায়াবেটিস কেবল বংশগত বা বয়স্কদের রোগ। ২. প্রাথমিক শনাক্তকরণের ঘাটতি : নিয়মিত স্ক্রিনিং ও HbA1c পরীক্ষার সুযোগ এখনও সীমিত। ৩. স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দুর্বলতা : উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিতকর্মী ও ওষুধের অভাব রয়েছে। ৪. উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় : অধিকাংশ রোগীকেই নিজের খরচে চিকিৎসা চালাতে হয়, কারণ স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা দুর্বল। ৫. বিশেষজ্ঞের স্বল্পতা : দেশে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও ডায়াবেটিস এডুকেটরের সংখ্যা রোগীর তুলনায় অনেক কম। ৬. অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন : জাঙ্ক ফুড, মিষ্টিজাত খাবার, কোমল পানীয় ও ব্যায়ামের অভাব ডায়াবেটিস বৃদ্ধির মূল কারণ। ৭. সামাজিক বাধা : অনেকেই ইনসুলিন নিতে লজ্জা পান বা ভয় পান, যার ফলে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে না।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সরকার, চিকিৎসক সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নিচে কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ উল্লেখ করা হলো-
১. জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালা শক্তিশালী করা : সরকার ঘোষিত অসংক্রামক রোগ কর্মপরিকল্পনার আওতায় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসাকে সব স্তরে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাজেট ও তদারকি বাড়ানো জরুরি। ২. জনসচেতনতা বৃদ্ধি : স্কুল, কর্মক্ষেত্র, মসজিদ ও গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মসূচি চালু করতে হবে। মানুষকে চিনি কম খাওয়া, নিয়মিত হাঁটা, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ধূমপান বর্জনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ৩. স্ক্রিনিং ও প্রাথমিক শনাক্তকরণ : উচ্চঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (যেমন স্থূলকায় ব্যক্তি, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকা ব্যক্তি, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের) নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করতে হবে। ৪. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করা : উপজেলা ও কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, ওষুধ (মেটফরমিন, ইনসুলিন) ও গ্লুকোমিটার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ৫. ওষুধ ও ইনসুলিনের সহজলভ্যতা : স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানো, দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, যেন সব শ্রেণির মানুষ চিকিৎসা নিতে পারে। ৬. জীবনধারা পরিবর্তন : সমাজে ‘Walk for Diabetes’, কমিউনিটি ব্যায়াম, অফিসে স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। ৭. গবেষণা ও ডেটা সংগ্রহ : একটি জাতীয় ডায়াবেটিস রেজিস্ট্রি তৈরি করলে রোগের প্রকৃতি ও প্রবণতা বোঝা সহজ হবে এবং নীতিনির্ধারণে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস এখন জাতীয় স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। তবে এই রোগ পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য। সচেতনতা, আগাম শনাক্তকরণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০২৫-এর মূল বার্তা হলো- ‘জানুন এবং পদক্ষেপ নিন’; কর্মক্ষেত্র থেকে ঘর পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি সচেতন, সুস্থ ও উৎপাদনশীল ডায়াবেটিসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
ডা. শাহজাদা সেলিম : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব