পরিবারই হোক শেষ আশ্রয়
একসময় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে হতো, ওটা বিদেশি সমাজের বিষয়, যেখানে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, সম্পর্কগুলো হিসাবের খাতায় বাঁধা। অথচ আজ আমাদের সমাজেও সেই বাস্তবতা প্রবলভাবে উপস্থিত। ঢাকার অদূরে কিংবা বড় শহরগুলোর প্রান্তে গড়ে উঠছে একের পর এক বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে আশ্রয় নিচ্ছেন শত শত মা-বাবা, যাদের একসময় সংসার ঘিরেই ছিল সমস্ত জীবন, যাদের ত্যাগেই সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই সন্তানরাই আজ তাদের জীবনের শেষবেলায় রেখে আসছে একা, নিঃসঙ্গ কোনো কক্ষে। প্রশ্নটা তাই জাগে- এ কি কেবল সময়ের বাস্তবতা, নাকি আমাদের মানবিক ব্যর্থতা?
সমাজ বদলেছে, বদলেছে জীবনযাত্রা। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার এখন শহুরে জীবনের অপরিহার্য অংশ। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়- সবাই আলাদা ঠিকানায়, আলাদা ব্যস্ততায়। এই পরিবর্তন অনেক সময়ই অবধারিত, কারণ শহরের সীমিত জায়গা, কাজের চাপ আর প্রতিযোগিতার দুনিয়া পরিবারকে এক ছাদের নিচে রাখা কঠিন করে তুলেছে। তবু প্রশ্ন থাকে- কঠিন মানেই কি দূরত্ব? আধুনিক জীবনের সুবিধা নিতে নিতে আমরা কি অজান্তেই সম্পর্কের উষ্ণতা হারিয়ে ফেলছি?
আজকের প্রজন্ম অনেক সময় ভাবে, বৃদ্ধাশ্রম মানেই নিরাপত্তা, নিয়মিত চিকিৎসা আর যত্ন। সত্যি, সেখানে অনেক সুবিধা আছে। কিন্তু সুবিধা আর ভালোবাসা এক জিনিস নয়। যে সন্তান নিজের মায়ের মুখে ‘ভাত খেয়েছ?’ প্রশ্নটা শোনার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে, সে বৃদ্ধাশ্রমে যত অর্থই দিক না কেন, সেই অভাব পূরণ হয় না। একটি যুক্তি প্রায়ই শোনা যায়- সময়ের অভাব। আজকের কর্মব্যস্ত জীবনে সন্তানরা অফিস, ব্যবসা, সংসার সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত। বাবা-মাকে সময় দেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবুন, দিনে কয়েক মিনিট কথার সময়ও কি সত্যিই পাওয়া যায় না?
আসলে সমস্যা সময় নয়, সমস্যা অগ্রাধিকারের। আমরা আজকাল পরিবারের জায়গায় ‘প্রজেক্ট’ রাখি, সম্পর্কের জায়গায় ‘দায়িত্ব’। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানসিক দূরত্ব। বাড়ি বড় হচ্ছে, কিন্তু হৃদয়ের ঘরগুলো ছোট হয়ে আসছে।
বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কথা বললে বোঝা যায়, সেখানে থাকা মানুষগুলো সমাজের ত্যাগ করা শ্রেণি নয়, তারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন কোনো এক পরিবারের। কেউ ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা, কেউ শিক্ষক, কেউ মা- যিনি সন্তানের জন্য নিজের স্বপ্ন ত্যাগ করেছিলেন। তাদের অনেকেই বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা ভালো আছে, ব্যস্ত আছে। কথাটা বলতে গিয়ে চোখের কোণে জল লুকানোর চেষ্টা করেন।
আমরা প্রায়ই বলি, এটা পারিবারিক ব্যাপার। কিন্তু সমাজের কাঠামোই তো পরিবারকে প্রভাবিত করে। আজকের সমাজে বয়স্কদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বা মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা কোথায়? বৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একসময় সংস্কৃতির অংশ ছিল। এখন সেটা দায়িত্ব হিসেবে শেখাতে হয়। টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যম, এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা- সবখানেই প্রবলভাবে প্রচারিত হচ্ছে তরুণদের স্বাধীনতা আর নিজের জীবন বেছে নেওয়ার অধিকার। কিন্তু শেখানো হচ্ছে না সেই জীবনের পেছনের ত্যাগের কথা। যে সমাজে বৃদ্ধদের আর্থিক ও সামাজিক অবদান ভুলে যাওয়া হয়, সেখানে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়বে, না কমবে?
নিঃসঙ্গতা আজ বয়স্কদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সন্তান না থাকলেও অনেক মা-বাবা তাদের ঘরে থাকতে চান, কেবল যেন আশপাশে পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পান। কিন্তু একাকিত্বের যন্ত্রণা ধীরে ধীরে মানুষকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রংশ, ডিমেনশিয়া- এসব রোগের পেছনে বড় কারণ হলো মানসিক নিঃসঙ্গতা। তবে সমালোচনার ভার শুধু সন্তানদের ঘাড়ে চাপানোও ঠিক নয়। প্রজন্মের ফারাক, চিন্তার ব্যবধান- এগুলোও বুঝতে হবে। অনেক সময় মা-বাবাও সন্তানদের জীবনে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা প্রত্যাশা আনেন, যা সম্পর্ককে চাপের মুখে ফেলে। তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া জরুরি। বাবা-মাকে যেমন সন্তানদের আধুনিক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে, তেমনি সন্তানদেরও বুঝতে হবে বৃদ্ধ বয়সে মানুষ আবার শিশু হয়ে যায়, তখন তাদের পাশে থাকা মানে কেবল দায়িত্ব নয়, এক ধরনের নৈতিক ও আবেগিক ঋণ পরিশোধ।
বিদেশে থাকা সন্তানরা বলেন, ভিডিও কলে তো প্রতিদিনই কথা হয়। কিন্তু পর্দার ওপারের মানুষটি যখন ফোন রেখে ঘরটায় একা বসে থাকেন, তখন সেই স্ক্রিনের আলো তাকে উষ্ণতা দেয় না। প্রযুক্তি যোগাযোগ সহজ করেছে, কিন্তু অনুভবের ফাঁকটা আরও বড় করে তুলেছে। তাই প্রয়োজন বাস্তব উপস্থিতি; একসঙ্গে বসা, গল্প শোনা, হাত ধরা, সেই পুরনো দিনের মতো একবার মায়ের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া।
প্রায় সব ধর্মেই পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্নকে সর্বোচ্চ কর্তব্য বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তব সমাজে এই শিক্ষাগুলো অনেক সময় কেবল বইয়ের পাতায় আটকে থাকে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োগ যদি আমরা পরিবার থেকে শুরু করি, তাহলে হয়তো বৃদ্ধাশ্রম একদিন কমে যাবে, মুছে যাবে, নয়তো একান্ত প্রয়োজনেই থাকবে; বাধ্যতার কারণে নয়, সম্মানের কারণে।
বৃদ্ধাশ্রম হয়তো প্রয়োজনের বাস্তবতা, কিন্তু বাবা-মাকে সেখানে পাঠানো কখনোই মানবিক অগ্রগতি নয়। এটা আমাদের ভালোবাসার ঘাটতি, সম্পর্কের পরাজয়, হৃদয়ের ব্যর্থতা।
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
আরিফুল ইসলাম রাফি : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়