প্রযুক্তির যুগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার
অনিতার বিয়ে হয়েছে সম্প্রতি। বর ইকবালকে নিয়ে গিয়েছিলেন কক্সবাজার। সাত দিন পর ফিরে এলেন। মধুচন্দ্রিমার মধুময় স্মৃতি এখন দুঃস্বপ্নের মতো। কে বা কারা সমুদ্রস্নানের অসতর্ক মুহূর্তের ভিডিও ও ছবি অন্তর্জালে ভাইরাল করে দিয়েছে। তাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবন হয়ে উঠেছে বিষাক্ত।
এ শুধু অনিতা-ইকবাল দম্পতির ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, আমাদের সমাজে এখন এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। সবার হাতে স্মার্টফোন- কিছু ঘটলেই কেউ না কেউ ভিডিও করছে, এরপর ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। ব্যক্তিগত মুহূর্ত এখন বাজারের পণ্য। পর্যটনকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, পার্ক থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়- সবখানেই অনুমতি ছাড়া ছবি ধারণ ও প্রকাশের প্রবণতা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। যেন আইন, নীতি ও নৈতিকতা মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে।
আমার সাবেক কর্মস্থলের একটি অভিজ্ঞতা আমাকে বিস্মিত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা চলাকালে এক কর্মকর্তা সাক্ষ্য হিসেবে গোপনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ ও অডিও রেকর্ডিং উপস্থাপন করেন। গর্বের সঙ্গে জানান- প্রয়োজনে যেকোনো ব্যক্তির ফোন কল তার অজান্তেই রেকর্ড করতেন। আমি বলেছিলাম- বিষয়টি বেআইনি, অনৈতিক এবং প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু উপাচার্যসহ উপস্থিত অনেকে বিস্মিত হন- যেন এটি কোনো অন্যায় নয়, বরং সাধারণ ও স্বীকৃত আচরণ। অথচ আমাদের সংবিধান একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তবে তা সমাজের প্রতিটি স্তরে উপেক্ষিত হচ্ছে।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণা মানুষের স্বাধীন অস্তিত্ব ও মর্যাদাবোধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। জন স্টুয়ার্ট মিল তার On Liberty গ্রন্থে বলেছেন- রাষ্ট্র বা সমাজের হস্তক্ষেপ তখনই ন্যায্য, যখন তা অন্যের ক্ষতি রোধে প্রয়োজন হয়; অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের নিজের জীবন ও চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
এই গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণার (ICCPR) ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা গৃহজীবনে বেআইনি হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তেমনি তার সুনাম বা সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাতও নিষিদ্ধ। এই হিসাবে টেলিফোনে আড়ি পাতা, কারও ফোনালাপ পর্যবেক্ষণ বা রেকর্ড করে তা প্রকাশ করা বাংলাদেশে আইনবিরুদ্ধ।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাধারণ ব্যক্তি থেকে রাজনীতিক, এমনকি সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-আমলাও আজ গোপনীয়তার সুরক্ষা পাচ্ছেন না। যারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্বে, তারাও আজ নিজেরাই এর শিকার।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দেশে ফোন কলে আড়ি পাতা ও তা প্রকাশ ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত সবার জন্যই নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করে ৭১ ও ৯৭(ক) ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গোয়েন্দা, নিরাপত্তা, তদন্ত বা আইন-শৃঙ্খলা সংস্থাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে এর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া অন্যান্য অ্যাপে করা কলও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জীবনের অধিকারের মতো ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তাও একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কেউ এই অধিকার লঙ্ঘন করলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে রিট করা যায়। যদিও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন নেই, তবে বিভিন্ন আইনে কিছু আংশিক সুরক্ষা রয়েছে। তথ্য অধিকার আইনেও ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কিত কিছু অনুচ্ছেদ আছে। এর মধ্যে রয়েছে- আয়-ব্যয়, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ (ফোন, পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র), বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি বিষয়ে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা।
দুঃখজনকভাবে, এখন পুলিশের তল্লাশি কিংবা প্রশাসনিক নজরদারির নামে সাধারণ মানুষের মোবাইল তল্লাশি ও ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা-গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন নিয়মে পরিণত করেছে।
আজ মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা যেমন নিরাপত্তা দিয়েছে, তেমনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বড় হুমকিও তৈরি করেছে। নারীদের উত্ত্যক্ত করা, তাদের অজান্তে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। প্রায়ই দেখা যায়- ‘বিয়ের প্রলোভনে স্কুলছাত্রীর নগ্ন ভিডিও’, ‘ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ’, ‘প্রেমিকের সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস’ ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তি কখন, কোথায়, কতটা তথ্য প্রদান করবেন- সে বিষয়ে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের অধিকার থাকা জরুরি। ব্যক্তিগত তথ্য কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে বা সীমা কোথায় তা জানার ও প্রশ্ন করার আইনি অধিকারও থাকতে হবে। অন্যথায় বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা- সবই খর্ব হয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় কোনো নারীর শালীনতার প্রতি অমর্যাদাকর কোনো শব্দ, অঙ্গভঙ্গি বা কাজ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টির সঙ্গে উইম্যান মডেস্টির সংযুক্তি ইউনিক ও জটিল হওয়ায় বিচারিক দৃষ্টান্ত এখনও অপ্রতুল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬ ও ২৯ ধারায় কারও অনুমতি ছাড়া তার পরিচিতিমূলক তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার বা প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে পর্নোগ্রাফিতে রূপান্তর করলে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৪ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা প্রযোজ্য।
যদিও এসব আইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কিছু সুরক্ষা রয়েছে, তবু কোনো নির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ আইন নেই। ফলে এ ধরনের যৌন হয়রানির শিকার নারীরা প্রায়ই নিজেদের অধিকার নিয়ে বিভ্রান্ত থাকেন এবং আইনি সহায়তা নিতে সাহস পান না।
এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য হলো BNWLA বনাম বাংলাদেশ (2009) 21 BLD 415 মামলায় উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনা। সেখানে নারী ও শিশুকে যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষার জন্য ১১ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা আইন প্রণয়নের ঘাটতি পূরণের একটি রূপরেখা হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের আইন এখনও এ বিষয়ে স্পষ্ট নয়। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘিত হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ফৌজদারি শাস্তির বিধান থাকলেও ভুক্তভোগীর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই। কেবল অপরাধ ঘটার পরেই আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু অপরাধ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই।
তাই এখন সময় এসেছে, এসব সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করার বিষয়ে আইন করেছে- বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। যেমন, ভারতে দণ্ডবিধির ৩৫৪(সি) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারীকে এমন পরিস্থিতিতে দেখা বা ছবি তোলা, যেখানে তিনি সাধারণত পর্যবেক্ষিত হওয়ার আশা করেন না, তা অপরাধ। একইভাবে ৩৫৪(ডি) ধারায় যেকোনো ধরনের অনুসরণ (stalking), সরাসরি বা অনলাইনে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার জার্মানিতে ফৌজদারি বিধির ২০১(এ) ধারায় বলা হয়েছে- এমন কোনো ছবি তৃতীয় পক্ষের কাছে প্রেরণ নিষিদ্ধ, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনামকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কাজী লতিফুর রেজা : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, আরপি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়