সহিংসতার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়
লকডাউনের নামে নাশকতা
রাজধানী ঢাকায় আবারও একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘ঢাকা লকডাউন’ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। এতে দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন, প্রাণহানি এসব ঘটনা একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তুলছে, তাই রাজনৈতিক সহিংসতা কারও কাম্য নয়।
গত কয়েকদিনে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় যে সহিংসতা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ হতে পারে না। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ঘুমন্ত চালক জুলহাস মিয়ার আগুনে পুড়ে মৃত্যু মানবতার চরম অবমাননা। রাজনীতি কখনও নিরপরাধ মানুষের জীবনের বিনিময়ে টিকে থাকতে পারে না। গত অক্টোবর মাস থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন ১৪টি ঝটিকা মিছিল করেছে। মিছিল ও নাশকতার অভিযোগে ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, হেলমেট ও মাস্ক পরে ভোরবেলায় বা ব্যস্ত সময়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। এসব কাণ্ডে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাড়াটে লোক ও ভাড়ায় খাটা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে দ্রুত ককটেল নিক্ষেপ করে সটকে পড়ছে অপরাধীচক্র। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়া একেবারে যৌক্তিক। রাজধানীসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন, পেট্রোল বিক্রি নিয়ন্ত্রণ, সাইবার মনিটরিং বাড়ানো ও তল্লাশি জোরদারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কারণ নাশকতা প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জরুরি। একই সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদেরও সতর্ক থাকতে হবেÑ অপরিচিত কাউকে আশ্রয় না দেওয়া, সন্দেহজনক কার্যক্রম দেখলে পুলিশকে জানানোÑ এগুলো নাগরিক দায়িত্বের অংশ। তবে শুধু কঠোরতা নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাও। এ ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডের পেছনে যে কারণগুলো কাজ করছেÑ রাজনৈতিক হতাশা, নেতৃত্বশূন্যতা, প্রবাসী নেতাদের উসকানি এগুলো মোকাবিলা করতে হবে কৌশলে। অনলাইন প্রোপাগান্ডা ও গুজব ঠেকাতে সরকারের তথ্য সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর হতে হবে।
বিশেষ করে ২০১৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তিন মাসেই পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১৫৩ জন সাধারণ মানুষ। আহত হন দুই হাজারেরও বেশি, যাদের অনেকেরই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারও হাত, কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আমরা সে সময়ের পুনরাবৃত্তি আর চাই না। সেজন্য অগ্নি সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও কঠোর হতে হবে। যদিও সরকার বলছে, অগ্নিসন্ত্রাসের রাজনীতি আর কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। কোনো ধরনের নাশকতা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো মতভেদ ও প্রতিবাদের সাংবিধানিক সুযোগ। কিন্তু ককটেল, আগুন, প্রাণহানি কখনও গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। রাজনীতি যদি নাশকতার পথে যায়, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ দেয় জনগণ চালক, শ্রমিক, পথচারী, সাধারণ নাগরিক। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাই বুঝতে হবে ক্ষমতার লোভে বা প্রতিশোধের মানসিকতায় তারা যেন দেশের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে না ঠেলে দেয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে যে, সহিংসতার মাধ্যমে কোনো দল বা গোষ্ঠী কখনও টিকে থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বর্তমান সরকারের সামনে এখন দুটি দায়িত্বÑ একদিকে নাশকতা কঠোর হাতে দমন করা, অন্যদিকে জনগণকে আশ্বস্ত রাখা যে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন আছে। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে যেন আর কোনো জুলহাস মিয়ার জীবন না ঝরে এই প্রতিজ্ঞাই এখন জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। যারা নাশকতার মাধ্যমে রাজনীতি করতে চায়, তারা শেষ পর্যন্ত জনগণেরই শত্রুতে পরিণত হয়। ঢাকা লকডাউনের নামে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে না ঠেলে দেয়। আজকের ঢাকা লকডাউন কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আরও কঠোর হবেÑ এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।