মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে করণীয়

বিভাস গুহ
১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৪
শেয়ার :
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে করণীয়

প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিশুর শিক্ষাজীবনের ভিত্তি। ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়, তবে শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পদে চলার পথে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শিক্ষাজীবনের ভিত্তি মজবুত করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী এবং দৃঢ় করে গড়ে তুলতে হয়। শিশুর ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তা না হলে পরবর্তী শিক্ষাস্তরে কঠিন বেগ পেতে হয়। যার ফলে অনেক সময় দেখা যায় প্রাথমিক শিক্ষাস্তর শেষে কিছু শিশু ঝরে পড়ে। তার মূল কারণ শিশুর শিক্ষার দুর্বল ভিত্তি। কারণ শিক্ষার প্রতি যদি কোনো শিক্ষার্থীর ভয়ভীতি বা আতঙ্ক কাজ করে তবে সে শিশু বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট গণ্ডির মাঝে আর আবদ্ধ থাকতে চায় না। বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে শিশু অস্বস্তিবোধ করে। বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শৈশবকাল থেকে শিশু যদি লেখা ও পড়ায় দুর্বল থেকে যায় বা দুর্বল ভিত্তি নিয়ে বেড়ে ওঠে কিংবা স্বাধীন পাঠক হতে না পারে, সাবলীলভাবে পড়তে এবং লিখতে না পারে তবে শ্রেণি কার্যক্রমে তার স্বতঃস্ফূর্ততা আসে না, ফলে সে শিশুর কাছে বিদ্যালয় আনন্দের হয় না। বিদ্যালয়ে যত আনন্দময় পরিবেশ থাকুক না কেন, শিশু সে পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চায়। শ্রেণি পাঠদান যতই আনন্দদায়ক হোক না কেন, শিশু যদি পড়ালেখায় একেবারে পিছিয়ে থাকে বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে তবে সে শিশু পড়ালেখায় আনন্দ খুঁজে পায় না। সব শিশু একই মেধার অধিকারী হবে তা কিন্তু নয়। মেধার তারতম্য থাকবে, কিন্তু কিছু শিশু একেবারে পিছিয়ে থাকে। তাদের যতই মাতৃস্নেহে বা পিতৃস্নেহে আদর-যত্ন করে পড়ানো হোক না কেন কিংবা শ্রেণি কার্যক্রমের বাইরে তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হোক না কেন, তাদের দুর্বলতা কাটানো যায় না। অনেকে হয়তো বলবে এটা শিক্ষকদের দুর্বল দিক। শতভাগ শিশুকে প্রতিটি পাঠের শিখনফল অর্জন করানো শিক্ষকের প্রতিদিনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটা দিনের আলোর মতো সত্য। কিন্তু শিশু পাঠে পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ রয়েছে, সেগুলোও বিবেচনায় রাখা দরকার; যেমনÑ শিশুর পরিবারে পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক সচ্ছলতার অভাব, মাতা-পিতার বিচ্ছেদ, সৎমায়ের শাসন, মাতা-পিতার স্নেহ-মমতা-আদরের অভাব, মাতৃহীন শিশু, পারিবারিক কাজে সহযোগিতা, লেখাপড়ার প্রতি মাতা-পিতার চরম উদাসীনতা, অল্পবয়সে সন্তানকে রোজগারের প্রতি ঠেলে দেওয়া, পিতার ছোটখাটো ব্যবসায় সন্তানকে ব্যবহার করা ইত্যাদি কারণে অনেক শিশু নিয়মিত বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পরও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন এ প্রশ্নটি আজ হয়তো সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যেসব বাধা সেগুলো এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক মানুষ এখনও অসচেতনতার বেড়াজালে আবদ্ধ। শিক্ষার প্রতি এখনও শতভাগ মানুষকে সচেতনতার গণ্ডিতে আনা সম্ভব হয়নি, ফলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে বিলম্ব হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাচক্র সমাপন করে শতভাগ শিক্ষার্থী বাংলা ও ইংরেজি সাবলীলভাবে পড়তে না পারার এটাও একটা বড় কারণ। যদিও শিক্ষক হিসেবে সব শিক্ষার্থীকে স্বাধীন পাঠক বা সাবলীল পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু শিক্ষকরা বারবার এসে এই জায়গায় হোঁচট খাচ্ছেন। অবশ্য শিক্ষকরা এটা থেকে উত্তরণের জন্য অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক, র‌্যালি, জাতীয় দিবস উদযাপন, শ্রেষ্ঠ অভিভাবক পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ উপস্থিতি পুরস্কার, হোম ভিজিট করে এলাকার মানুষকে সচেতন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং তাতে সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। এর পরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। শতভাগ ভর্তিযোগ্য উপস্থিতি প্রতিদিন নিশ্চিত করতে মোবাইলে যোগাযোগ করছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠক করছেন। এসব সচেতনতামূলক কার্যক্রম সুফল বয়ে আনছেÑ এ ব্যাপারে শিক্ষকসমাজ অত্যন্ত আশাবাদী। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। প্রাথমিক শিক্ষা আগের চেয়ে দিন দিন অনেকদূর এগিয়ে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শিক্ষকসমাজের অবদান শতভাগ। প্রাথমিক শিক্ষার যে এগিয়ে যাওয়া, তা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখছে।


বিভাস গুহ : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক


মতামত লেখকের নিজস্ব