শিকড় ভোলা যাবে না

আরমীন আমীন ঐশী
১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫
শেয়ার :
শিকড় ভোলা যাবে না

কখনও কখনও মনে হয় শহরটা আর মানুষ নয় বরং এক বিশাল যন্ত্র, যে ক্রমাগত শব্দ করছে, ধোঁয়া ছাড়ছে আর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে নিজের হৃৎস্পন্দন। একসময় এই শহরে সকালের হাওয়া মানে ছিল পাখির ডাক, রোদে শুকানো কাপড়ের গন্ধ, টং দোকানের চায়ের ভাপ। এখন সকাল মানে হর্ন, ধুলো আর ফোনের নোটিফিকেশন। এই শহর একদিন ছিল কাব্যের মতো। রিকশার ঘণ্টির শব্দে জেগে উঠত অলিগলি, ছাদের দড়িতে উড়ত ঘুড়ি, পুরান ঢাকার রান্নাঘরে ফুটত শাহী বিরিয়ানির ঘ্রাণ। আজ সেই শহর কাচের দেয়ালের পেছনে বন্দি।

নতুন প্রজন্ম জানে আইফোনের নতুন মডেল, কিন্তু জানে না শীতলক্ষ্যা নদীর নাম কী অর্থ বহন করে। আমরা উন্নত হয়েছি কিন্তু আমাদের চারপাশের গল্প হারিয়ে যাচ্ছে, যেন শহরের প্রতিটি ভবন নতুন হয়ে উঠছে আর প্রতিটি স্মৃতি পুরনো হয়ে নিঃশব্দে মরছে। এই হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলোর নামই ঐতিহ্য।

ঐতিহ্য মানে কেবল পুরনো পোশাক আর স্থাপনা নয়; বরং এটা এক জাতির আত্মপরিচয়, এক শহরের প্রাণের ভাষা। কোনো দেশের উন্নতি তখনই অর্থবহ হয় যখন তার আধুনিকতা নিজের শিকড়কে ভুলে না যায়। কিন্তু আজকের নগরজীবন ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ছিল একসময় মসজিদের শহর, রন্ধনের শহর, কবির শহর। মোগল আমলের সেই সৌন্দর্য, নবাবদের স্থাপত্য, ঘরোয়া সংস্কৃতি সবই এই শহরের গর্ব ছিল। কিন্তু আজকের ঢাকায় ঐতিহ্য যেন বেঁচে আছে শুধু দেয়ালের ছবিতে, পোস্টারে আর বইয়ের পাতায়।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় শহর পাল্টেছে দ্রুত। কংক্রিটের দেয়ালে হারিয়ে গেছে পুরান ঢাকার গলির সৌন্দর্য, হারিয়ে গেছে একসঙ্গে বসে পিঠা খাওয়ার আনন্দ, হারিয়ে গেছে মেলা, গানের আসর আর পাড়ার মিলনমেলা। আমরা এখন এমন এক সময়ের বাসিন্দা যেখানে সংস্কৃতি মানে সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড আর ঐতিহ্য মানে ইতিহাস বইয়ের অধ্যায়। পুরান ঢাকায় যে পুরনো দোতলা বাড়িগুলো ছিল, যেগুলোর দেয়ালে লেগে ছিল শত বছরের ইতিহাস সেগুলো এখন একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। জায়গা নিচ্ছে চকচকে কাচের অ্যাপার্টমেন্ট।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৭০% তরুণ এখন বিদেশি উৎসব যেমন ভ্যালেন্টাইনস ডে, হ্যালোইন, নিউইয়ার পার্টিতে বেশি আগ্রহী, সেখানে স্থানীয় ঐতিহ্য যেমন নববর্ষ, পিঠা উৎসব বা নবান্নের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কারও কারও কাছে পহেলা বৈশাখ মানে এখন শুধু ছবি তোলা আর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দেওয়া। তবে একসময়ের খেলার মাঠ ছিল হাডুডু, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা আর ঘুড়ি ওড়ানোর সরগরম। এখন সেই মাঠগুলো দখল হয়ে গেছে গাড়ি পার্কিংয়ে। শিশুরা জানে না গ্রামের মেলা কেমন হয়, তাদের আনন্দের জগৎ এখন বন্দি হয়ে গেছে মোবাইল গেমে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বোরহানি, নেহারি, মোরগ পোলাও এখন ব্র্যান্ডেড রেস্টুরেন্টে ডিশ হয়ে বিকোচ্ছে। ঐতিহ্য এখন বাণিজ্যের অংশ, সংস্কৃতির নয়। শুধু খাবার নয়, সেই সঙ্গে সংগীত, পোশাক, কথা বলার ধরন, এমনকি উৎসব উদ্্যাপনের ভাবও বদলে গেছে। আধুনিকতা এসেছে কিন্তু তার সঙ্গে এসেছে একরকম ফাঁকা অনুভূতিও।

ঐতিহ্য বাঁচানো মানে পুরনো হয়ে থাকা নয় বরং নিজের শিকড়কে নতুনভাবে বাঁচিয়ে রাখা। পুরান ঢাকার স্থাপত্য, পুরনো বাড়ি, প্রাচীন মসজিদ এসব সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুদের স্কুলেই শেখানো উচিত নিজেদের ইতিহাস, গান, গল্প, লোকসংস্কৃতি, এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিকড় হারাবে না। সেই সঙ্গে মিডিয়া যদি স্থানীয় সংগীত, নাটক, খাবার, উৎসব তুলে ধরে তাহলে মানুষ নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে আবার সংযুক্ত হবে।

প্রত্যেক মানুষকেই নিজের সংস্কৃতি বাঁচানোর দায় নিতে হবে। পরিবারের ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন, ভাষার যত্ন, স্থানীয় পণ্যের ব্যবহার এগুলো ছোট পদক্ষেপ হলেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে। নগর পরিকল্পনায় ঐতিহাসিক এলাকাগুলোকে সংরক্ষণযোগ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা উচিত, যাতে উন্নয়নের নামে ইতিহাস ধ্বংস না হয়।

নগরায়ণ থামানো যাবে না কিন্তু ঐতিহ্যের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। শহর যখন বড় হয় তখন তার আত্মা যেন ছোট না হয় এটাই মূল কথা। আমরা হয়তো সময়ের সঙ্গে বদলে যাব কিন্তু নিজেদের শিকড় ভুলে গেলে আমাদের আধুনিকতা অর্থহীন হয়ে যাবে। নগরের আলো যতই ঝলমলে হোক না কেন, যদি সেই আলো আমাদের ইতিহাসের ছায়া ঢেকে দেয় তাহলে তা উন্নতি নয় বরং এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। আর একটা শহরের সৌন্দর্য কেবল তার বিল্ডিংয়ে নয়, তার স্মৃতিতেও। ঐতিহ্যই শহরের আত্মা, আর সেই আত্মা বাঁচাতে হলে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

ঐতিহ্য এমন এক সোনার নকশা, যা মুছে গেলে শহর শুধু কংক্রিট আর ধোঁয়ায় ভরে যাবে। আমাদের শহর যেন আবার পাখির ডাক শুনে জাগে, যেন নববর্ষের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার রঙে ভরে ওঠে, যেন পুরান ঢাকার ছাদে আবারও ঘুড়ি ওড়ে- এই স্বপ্নটুকু ধরে রাখার দায় আমাদেরই। আমরা যদি এখন না ভাবি তাহলে একদিন আমাদের সন্তানরা হয়তো বলবে, ঢাকা শহর? ওটা একসময় সুন্দর ছিল। কিন্তু শহর যেন কোনোদিন অতীত হয়ে না যায় সেই দায়িত্ব আমাদের সবার।


আরমীন আমীন ঐশী : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়