অবিলম্বে সমাধান করুন
প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গভীর সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে বেতন-গ্রেড ও পদোন্নতির ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় শিক্ষকসমাজে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে, তার বিস্ফোরণ ঘটে এখনকার কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচিতে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সরকার বারবার অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করলেও বাস্তবতা হলো- এই শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড যারা, সেই সহকারী শিক্ষকরা নিজেদের মৌলিক প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। আর সেই বঞ্চনার প্রতিবাদে তারা যখন রাজপথে নামছেন, তখন আন্দোলন দমন করতে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষাক্ষেত্রের আন্দোলন এমন শক্তিপ্রয়োগের মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়। এটি শুধু নৈতিক নয়, প্রশাসনিকভাবেও ব্যর্থতার পরিচয়। আশ্বাসবাণীর বিপরীতে বাস্তব অগ্রগতি না থাকায় শিক্ষক নেতাদের ঘোষণার পরপরই মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হওয়া ছিল প্রত্যাশিত। কারণ অতীতে একাধিকবার শিক্ষকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরকারকে আশ্বাস দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের পরও কোনো সমাধান পাননি। তাই এবার তারা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব বাস্তবায়নের লিখিত নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি স্থগিত করতে প্রস্তুত নন। ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ, দ্রুত উচ্চতর গ্রেড প্রদান ও শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির দাবি মোটেও অতিরঞ্জিত নয়।
অন্য মন্ত্রণালয়ের সমপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষকরা যে বৈষম্যের শিকার- সেটি পরিসংখ্যান দ্বারাই প্রমাণিত। যারা ৯৬ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ গঠনে কাজ করেন, তাদের উপযুক্ত মর্যাদা ও সুবিধা নিশ্চিত না করা হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যে কোনো আলোচনা অর্থহীন। তবে এ সংকট শুধু শিক্ষকদের নয়; এটি পুরো প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিরাট আঘাত। ৬৫ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ের ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষক যখন কর্মবিরতির ডাক দেন, তখন লাখো শিক্ষার্থীর নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়, শেখার আনুষ্ঠানিকতা ভেঙে গিয়ে শিশুরা শৃঙ্খলার বাইরে চলে যায়। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিশুরা নিয়মিত শিক্ষার অভ্যাস হারালে ভবিষ্যতে তাদের পাঠ্যক্ষমতা, মনোযোগ ও আগ্রহ পুনর্গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অভিভাবকদের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, একে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো- সংলাপের বদলে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। শিক্ষকরা যখন শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি করছিলেন, তখন পুলিশি আক্রমণ শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, সরকারের প্রতি শিক্ষকসমাজের আস্থা আরও দুর্বল করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের উচিত ছিল তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা। এতে কেবল আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছে, দ্বন্দ্ব আরও গভীর হয়েছে। আশ্বাস দিয়ে দিনের পর দিন সময়ক্ষেপণ করলে সংকট আরও বিস্ফোরিত হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের তিন দফার মধ্যে বেতন-গ্রেড উন্নীতকরণ সবচেয়ে মূল দাবি। ১০ম গ্রেডে উন্নীত হলে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আর্থিক নিশ্চয়তাও তৈরি হবে। জটিলতার কারণে ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড পান না অনেক শিক্ষক- এটিও প্রশাসনিক জটিলতার দুঃসহ উদাহরণ। আর বিভাগীয় পদোন্নতিতে শতভাগ কোটার দাবি ন্যায্য; কারণ প্রাথমিক স্তরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকই প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয় পরিচালনার উপযুক্ত। বাইরে থেকে নিয়োগ বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় অদক্ষদের পদোন্নতি স্কুল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা তৈরি করে।
এ প্রেক্ষাপটে জরুরি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত, অর্থ মন্ত্রণালয়কে দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পুনর্মূল্যায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দাবি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একটি সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে, যাতে শিক্ষকসমাজের আস্থা ফিরতে পারে। তৃতীয়ত, পুলিশি হামলার ঘটনার তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে শিক্ষকসমাজকে সম্মান জানাতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মনে রাখতে হবে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের সংকট কেবল বেতন-ভাতার প্রশ্ন নয়; এটি রাষ্ট্রের মৌলিক শিক্ষানীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্ন। যারা জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন, তাদের নিশ্চিত মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে দেশে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়া সম্ভব নয়। এখনই জরুরি, শিক্ষকসমাজের প্রাপ্য স্বীকৃতি নিশ্চিত করা- এটাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিশুর ভবিষ্যৎ ও জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে অপরিহার্য পদক্ষেপ।