দিন বদলের স্বপ্নে গণমাধ্যম হোক প্রত্যয়ী

সফিক চৌধুরী
১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩১
শেয়ার :
দিন বদলের স্বপ্নে গণমাধ্যম হোক প্রত্যয়ী

বিগত সময়গুলোতে তো বটেই বর্তমানেও গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ একটু এদিক-সেদিক হলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, অবাধ, বস্তুনিষ্ঠ, মানসম্পন্ন ও মুক্ত গণমাধ্যমের স্বার্থেই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করতে বলেন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই কথার অন্তর্নিহিত বার্তাটি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না, মূলত সরকার ও দলের সমালোচনা প্রকাশের সময় গণমাধ্যম যেন অধিক সংযত ও সতর্কতার সঙ্গে সেটি করে।

শুধু গণমাধ্যমই নয়, সমাজের সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকেই স্বাধীনতা উপভোগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নিয়মকানুন মেনে সংযত ও দায়িত্বের সীমারেখার ভেতর চলতে হয়, সমাজে প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু যে কোনো সরকার ও দায়িত্বশীলদের এ কথাও বুঝতে হবে- গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা সরকার, রাজনৈতিক দল বা কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়, গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা তার পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের কাছে। দর্শক-পাঠক গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা করেন, সংবাদের নির্মোহ প্রকাশ ও তার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারের নানা চাপে পড়ে হোক বা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অথবা কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছায় বিগত আওয়ামী শাসনামলে আমাদের বেশকিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তৎকালীন সরকারের প্রতি অনুগত হয়ে পড়ায় গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের আস্থা আজ অনেকটাই তলানিতে। আমাদের সমাজে সত্যকে সহজে গ্রহণ করার সাহস অনেকেরই নেই, সেখানে ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি আর রাজনৈতিক দলগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। যে কোনো দেশ ও সমাজকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রাখে, এটি গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, তরুণদের জাগরণের এক অবিশ্বাস্য শক্তি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেক কিছুতেই আমরা আশাবাদী ছিলাম, কিন্তু বছর পেরোতেই নানা কারণে আমাদের স্বপ্ন আজ অনেকটাই মলিন। বিগত অনেক বছর যাবৎই ধীরে ধীরে করপোরেট সমাজ ক্রমাগত সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে আরও নিচের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, সমাজের চরম অসাম্য সৃষ্টি করতে চাইছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমাজের মানবিক মুখটাকে মাথা তুলেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না, অন্যদিকে ধর্মের নামে মৌলবাদীরা উগ্র দেশপ্রেমকে আরও লেলিয়ে দিতে চাইছেন, দুর্নীতি আর সন্ত্রাস সর্বগ্রাসী, বাজার ব্যবস্থাপনা এখনও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে, এমন কঠিনতম সময়ে গণমাধ্যমের বলিষ্ঠ ও কঠোর ভূমিকাই পারে এমন নানা অনাচারকে রুখতে, সাধারণ নাগরিকরাও আশা করে গণমাধ্যম তাদের হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের গণমাধ্যম যত দিন দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও সাহসী ভূমিকা নিতে না পারবে, তত দিন দেশের অনেক অনাচারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম দাঁড়াতে পারবে না। এ কথাও সত্যি, একটি আদর্শ গণমাধ্যম যথাযথ প্রমাণ ছাড়া অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। আবার যারা নানা দুর্নীতি ও অনাচারের সঙ্গে জড়িত তারা বাহ্যিক সহজ কোনো প্রমাণ রেখে সাধারণত এগুলো করে না। তাই মূলধারার গণমাধ্যম প্রায়ই অনেক কিছু জানলেও তা প্রকাশ করতে পারে না। তবে কোনো গণমাধ্যম এমন নানা অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা নিতে চাইলে তাদের পক্ষে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণাদি সংগ্রহ করা অসম্ভব কিছু নয়। যার প্রমাণ বিগত সময়ে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের কিছু গণমাধ্যম দেখিয়েছে। তাই আমরা আশাবাদী। অনেক সময়ই আমরা সমাজের অনেকের নানা দুর্নীতি, নানা ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট আর অনেকের অনেক অরাজকতার কথা শুনি, যা গণমাধ্যমের কাছেও অজানা থাকে না। তবুও দেখা যায়, মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে আমরা তেমন সোচ্চার লেখা পাই না। মূলত যথাযথ তথ্যপ্রমাণের অভাবই এর একটা বড় কারণ। আসলে আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অরাজকতা আর অব্যবস্থাপনার একটা কঠিন চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা। শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে না, আমাদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই এমন কঠিন চক্র সৃষ্টি করেছে। বিগত সময়গুলোতে রাজনীতিতে সৎ, যোগ্য ও ন্যায়বান রাজনীতিবিদদের ধীরে ধীরে কোণঠাসা করে সেখানে এখন অনেক ক্ষেত্রেই এসবের বিপরীতমুখীদের জয়জয়কার। তারা খুবই প্রভাবশালী। বিগত সময়গুলোতে গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সংসদ এমন মৌলিক অনেক কিছুই ছিল তাদের করায়ত্তে। ফলে গণমাধ্যম ও সচেতন নাগরিক সমাজ তাদের সঙ্গে লড়াই করে খুব একটা পেরে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজেরও তাদের সঙ্গে লড়াই করার খুব একটা ইচ্ছা ও ঐকান্তিকতা ছিল বলে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়নি। কারণ গণমাধ্যম ও সমাজের একটা অংশও সুবিধাবাদিতার শিকার। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের সব পর্যায়ের কর্মীদের হতে হবে নিবেদিতপ্রাণ, দক্ষ, নির্লোভ, অনুসন্ধিৎসু ও সাহসী, যারা সমাজকে সত্যিকার অর্থেই বৈষম্যহীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে নানা খাতে সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিটি করেছে। তার মধ্যে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনও রয়েছে। সেই কমিশন তাদের পেশকৃত প্রতিবেদনে গণমাধ্যমকর্মীদের নানা যৌক্তিক সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বাধীন ও জবাবদিহিতামূলক গণমাধ্যমের জন্য নানা কিছু সুপারিশ করেছে। যদিও পুথিগত সংস্কার দিয়ে কখনই জবাবদিহিমূলক, অনুসন্ধানী ও সাহসী গণমাধ্যম সৃষ্টি করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তার জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকে নিজেদেরই কিছু ব্যাপারে শক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

সে যাই হোক, সবকিছু ঠিক থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে কোনো নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কাছে সাধারণ নাগরিকদের কিছু স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে। সাধারণ মানুষ আশা করেন, এমন সময়ে গণমাধ্যম তাদের সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখবে, সংবাদ হবে পক্ষপাতমুক্ত এবং সম্পাদকীয়-মতামত ও বিচার-বিশ্লেষণ হবে ভারসাম্যপূর্ণ। আমাদের গণমাধ্যমগুলোকে আসন্ন নির্বাচনের স্বাভাবিক সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি ও দুর্বলতাগুলো বিশ্লেষণ করে দেশ পরিচালনায় তাদের সম্ভাব্য লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনা নাগরিকদের কাছে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকাকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর এটি নিঃসন্দেহে একটি সুবর্ণ সুযোগ। আমাদের গণমাধ্যম এমন সুযোগের পূর্ণমাত্রায় সদ্ব্যবহার করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।


সফিক চৌধুরী : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব