সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

প্রাণীর ওপর নৃশংসতা

সম্পাদকীয়
১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৯
শেয়ার :
সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা মানবিকতার মৌলিক ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল কিংবা ঘোড়ার মতো মানুষের সহচর প্রাণীগুলো মানুষের নিষ্ঠুরতার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে। আর এই নিষ্ঠুরতা শুধু পোষা প্রাণী বা গৃহপালিত প্রাণীর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়- বন্যপ্রাণীরাও একইভাবে মানুষের অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে আমরা দেখি, কেবল আনন্দ বা ‘ভাইরাল’ হওয়ার নেশায় মানুষ কেমন নির্মমভাবে প্রাণীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সমাজের একাংশ প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতাকে তুচ্ছ, গুরুত্বহীন বিষয় ভাবতেই অভ্যস্ত। ফলে নিষ্ঠুরতার মাত্রা কমার পরিবর্তে বাড়ছে। যে সমাজে প্রাণীকে জীব নয়, বস্তু হিসেবে দেখা হয়- সেই সমাজের মানুষ মানবিকতাহীন আচরণেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা কেবল নৈতিক ব্যর্থতা নয়, মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যা সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রাণীর ওপর অত্যাচার করে, তাদের মধ্যেই পরবর্তী সময়ে সহিংসতা, অপরাধপ্রবণতা এবং সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ মিলতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের সাম্প্রতিক নৃশংস ঘটনাগুলো এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।

বগুড়ার আদমদীঘিতে গলা কেটে বিড়াল হত্যা, ঢাকার ধানমণ্ডিতে চারটি বিড়ালের চোখ উপড়ে ফেলা, ময়মনসিংহে গাভীর জিহ্বা কেটে ফেলা কিংবা রাজবাড়ীতে ছাগল হত্যা- প্রতিটি ঘটনা আমাদের সমাজের মানসিক অসুস্থতাকে প্রকাশ করে। এই ঘটনা শুধু প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতা নয়, মানুষের মানবিক অবক্ষয়ের নির্মম প্রতিচ্ছবি। আরও আতঙ্কের বিষয়- এ ধরনের অপরাধ বেশির ভাগ সময়েই বিচারহীন থেকে যায়। প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯-এ নির্যাতনের সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এই আইন প্রায় অকার্যকর। প্রশাসনের উদাসীনতা, প্রয়োগ-সংক্রান্ত জটিলতা এবং সামাজিক উদাসীনতা নিষ্ঠুরতাকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে।

সমস্যার আরেকটি গভীর দিক রয়েছে- পরিবার ও সমাজে প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা শেখানো হয় না। আমাদের অনেক পরিবারে রাস্তার কুকুর বা বিড়ালকে ‘উপদ্রব’ হিসেবে দেখা হয়। বাবা-মা নিজেরাই লাঠি বা পাথর দিয়ে কুকুর-বিড়াল তাড়াতে উদ্যত হন, যা দেখে সন্তান উৎসাহ পায়। ফলে শিশুদের মধ্যে সহানুভূতিশূন্য, অমানবিক আচরণের বীজ বপিত হয়। মানবিক মূল্যবোধ শেখার শুরু শিশুকাল থেকেই। প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা শেখানো শুধু চার দেয়ালের পাঠ নয়, এটি সামাজিক শিক্ষাও বটে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে প্রাণী সুরক্ষা, পরিবেশ-সচেতনতা এবং জীবের প্রতি সহনশীলতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে প্রাণী কল্যাণ কমিটি গঠনের সুপারিশগুলোও দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে সচেতনতা বাড়বে, জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং নির্যাতনের ঘটনা কমবে। মনে রাখতে হবে, আইন শুধু কাগজে থাকলে তার কোনো মূল্য নেই। কার্যকর তদন্ত, অপরাধীর দ্রুত শাস্তি ও কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিতে হবে।

মানবিক সমাজ তৈরি করতে হলে আমাদের জীববৈচিত্র্যকে, প্রাণীদের স্বাভাবিক অস্তিত্বকে সম্মান জানাতে শিখতে হবে। কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণী পরিবেশের ময়লা পরিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; গরু-ছাগল কৃষির অংশ; বন্যপ্রাণী পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার সহায়ক- এগুলো বোঝা জরুরি। প্রাণীর সুরক্ষা মানে শুধু তাদের রক্ষা করা নয়- তা হলো পরিবেশ রক্ষা, নৈতিকতা রক্ষা এবং মানবিকতার চর্চা।

এখনই সময় সমাজকে মানবিকতায় ফিরিয়ে আনার। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে- পশুপাখিও জীব, তাদেরও ব্যথা আছে, অনুভূতি আছে। বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষক এবং সমাজের সব স্তরের মানুষের দায়িত্ব প্রাণীর প্রতি যত্নশীল আচরণকে উৎসাহিত করা। অন্যথায় আমরা এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলব, যারা নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক ভাববে। মানবিক সমাজ গড়তে হলে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতেই হবে, সহমর্মিতার বীজ রোপণ করতে হবে মানুষের হৃদয়ে। সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র- সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা নিশ্চয়ই মানবিকতার আলো ফিরিয়ে আনতে পারব।