সহিংসতা নয়, সম্মানের সংস্কৃতি গড়ে তুলি
নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এর জন্য বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই উদ্বেগজনক মাত্রায় নারীর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। প্রায়শই এটি স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গৃহীত হয় এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের বৈশ্বিক সংস্কৃতি দায়মুক্তির সঙ্গে সহিংসতা ঘটতে সম্মতি দেয়।
বৈষম্যমূলক মনোভাব ও আচরণ পরিবর্তনের জন্য এবং আইন ও সেবার উন্নতির জন্য সরকারকে লবিং করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন ব্যক্তি সারাবিশ্বে কাজ করছেন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে আমাদের সেই মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যা কিছু সহিংসতাকে স্থায়ী করে যৌক্তিক ও স্বাভাবিক করে তোলে এবং নারীর নিরাপত্তার অধিকারকে অস্বীকার করে। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে অপরাধী হিসেবে শুধু পুরুষরাই দায়ী নন, এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সবাই দায়ী। সত্যিকার অর্থে সহিংসতা দূর করতে হলে শুধু পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে বিষয়টি এমন নয়, আমাদের সবার দৃৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। যদিও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা খুব কঠিন, তবে এই পরিবর্তন করার দায়িত্ব আমাদের সবার নিতে হবে।
যখন নভেম্বর মাস আসে তখন আমরা সবাই সোচ্চার হই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য; বিভিন্ন মিটিং, সেমিনার, গোলটেবিল, মেলা ইত্যাদি আয়োজনের জন্য। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ শুধু এই ১৬ দিনের প্রতিরোধ পক্ষের কাজ নয়। সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য বছরের প্রতিটি দিনকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দিনের প্রতিটি ছোট ছোট বৈষম্যমূলক ঘটনাকে প্রাধান্যের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ছোট ছোট বৈষম্যের সূত্রপাত থেকেই বড় বৈষম্যের যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি দৈনন্দিন জীবনের এক টুকরো নির্যাতনের ঘটনাই ধীরে ধীরে ক্রমশ নির্যাতন চালিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করে।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যেমন আমরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠি, ঠিক তেমনি আমাদের মননে-মগজে বিভিন্ন রকম জেন্ডার স্টেরিওটাইপ গেঁথে থাকে; কারণ আমরা এই স্টেরিওটাইপের মধ্যে বেড়ে উঠি। একটি শিশু তার পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির আচরণ থেকে তার কাক্সিক্ষত আচরণ নির্বাচন করে এবং ভালো বা ক্ষতিকারক যে আচরণই সে নিজের মধ্যে লালন করে, সেটিকেই সে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়। ক্রমশ সে যখন বড় হতে থাকে তখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের আচরণই তার মাঝে প্রতিফলিত হয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষের ইতিহাসটিও খুবই নির্মম। ২৫ নভেম্বর ১৯৬০-এ বোন প্যাট্রিয়া, মিনার্ভা ও মারিয়া তেরেসা মিরাবল, তিনজন রাজনৈতিক কর্মী একসঙ্গে মিলে ডোমিনিকান রিপাবলিকের টরুজিলো স্বৈরাচারের নিষ্ঠুরতা ও নিয়মতান্ত্রিক সহিংসতার বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে টরুজিলোর গোপন পুলিশ তাদের একটি গোপন পাহাড়ের নিচে ফেলে দেয় এবং তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন থেকেই মিরাবল বোনেরা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং তাদের মৃত্যুর স্মরণে ১৯৮০ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলের জন্য ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিবসকে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
সময়ের প্রবাহে নারীর প্রতি সহিংসতার ধরনও বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতা, সামাজিক সহিংসতা, রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি এখন চরম আকারে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল সহিংসতা। তাই এ বছরের নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষের থিম ‘নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সকল ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধ করুন’।
ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা বিনোদন- সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট আমাদের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির সুফলের পাশাপাশি বেড়েছে ডিজিটাল সহিংসতার মতো ভয়াবহ একটি বাস্তবতা। নারীরা ও কন্যাশিশুরা অনলাইনে প্রতিনিয়ত হয়রানি, ট্রল, অপপ্রচার ও ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের শিকার হচ্ছেন। এই সহিংসতা শুধু মানসিক ক্ষতিই করে না, বরং নারীর আত্মবিশ্বাস, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই এখন সময় এসেছে- ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে নিরাপদ, সম্মানজনক ও সহিংসতামুক্ত করার জন্য ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডিজিটাল সহিংসতার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য, আইনি জ্ঞানের অভাব এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দায়বদ্ধতার ঘাটতি। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা সামাজিক লজ্জা বা ভয়ের কারণে অভিযোগ জানাতে দ্বিধা করেন, ফলে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। এ ছাড়া পরিবার ও সমাজের সচেতনতার অভাবও সমস্যাটিকে জটিল করে তুলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন বহুমাত্রিক পদক্ষেপ, যেমন- সাইবার অপরাধ দমন আইনের কার্যকর প্রয়োগ, অনলাইন নিরাপত্তা শিক্ষা, প্রযুক্তি ব্যবহারে জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সম্মানজনক অনলাইন আচরণ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ফারজানা আকতার : উন্নয়নকর্মী
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মতামত লেখকের নিজস্ব