ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হোক

আলুচাষ

সম্পাদকীয়
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৭
শেয়ার :
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হোক

দেশের কৃষকরা আজ চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার মুখে। একসময় যে আলুকে বলা হতো ‘সোনার ফসল’, সেই আলুই এখন কৃষকের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। চলতি মৌসুমে আলু চাষ করে তারা যে লোকসানের মুখে পড়েছেন, তা শুধু তাদের জীবিকা নয়, দেশের কৃষি অর্থনীতিকেও বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এ বছর কৃষকরা কেজিপ্রতি ২৫ টাকার মতো খরচ করে আলু উৎপাদন করেছেন। অথচ বাজারে এখন আলুর দাম পাইকারিতে ১০ থেকে ১২ টাকা, খুচরায় ১৫ থেকে ২০ টাকা। অনেক জায়গায় হিমাগারে বিক্রি হচ্ছে ৯ থেকে ১১ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে কৃষক ক্ষতি গুনছেন ১৫ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। শুধু মুন্সীগঞ্জ জেলায়ই ক্ষতির অঙ্ক দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের ৩৪০টি হিমাগারে প্রায় ১৭ লাখ টন আলু অবিক্রীত পড়ে আছে- যা কৃষকের জন্য বড় ধাক্কা। এই বিপর্যয়ের মূল কারণ শুধু উৎপাদন বাড়তি হওয়া নয়, বরং সরকারের অদূরদর্শী বাজার ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে ব্যর্থতা। সরকার এ বছর ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু ঘোষণার দুই মাস পরও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কৃষকের হাতে টাকা-পয়সা না ফিরলে তারা পরবর্তী মৌসুমে চাষ কমাবে, যার প্রভাব পড়বে আগামী বছরের বাজারে। অর্থনীতিবিদরা সঠিকই বলছেন- যদি সরকার উৎপাদনের অন্তত ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ লাখ টন আলু ন্যায্যমূল্যে সংগ্রহ করত, তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকত এবং কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত।

কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন বীজ আলুও খাবার আলু হিসেবে বিক্রি করতে, যা আগামী মৌসুমে উৎপাদন কমিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যতে বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি করবে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষি খাতের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা কেবল মৌখিক আশ্বাসে সীমাবদ্ধ থাকলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ধসে পড়বে। উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে কৃষক, যার ফল ভোগ করবে গোটা দেশ। এখন শুধু সংরক্ষণ নয়, আলুর বহুমুখী ব্যবহার ও শিল্পায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে কোল্ডস্টোরেজগুলো এখনও কেবল সংরক্ষণের কাজেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু আলু থেকে তৈরি করা যায় নানা প্রক্রিয়াজাত পণ্য- চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলুর গুঁড়া, আলুভিত্তিক স্ন্যাকস এবং স্টার্চ, যা শিল্প খাতে মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। টেক্সটাইল, ওষুধ, কাগজ ও আঠাশিল্পে আলুর স্টার্চের চাহিদা বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে। সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে যদি এই শিল্পে বিনিয়োগ করে, তাহলে কৃষকরা নতুন বাজার ও মূল্য সংযোজনের সুযোগ পাবেন।

তবে প্রক্রিয়াজাত বা রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদনের জন্য মান ও সাইজের দিকেও নজর দিতে হবে। আমাদের দেশের আলু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সময় গ্রহণযোগ্য হয় না- মূলত আকার, মান ও সংরক্ষণ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাইজ, আর্দ্রতা, রঙ ও রোগমুক্ত আলুই রপ্তানির উপযুক্ত। এই মান রক্ষা করতে হলে কৃষককে বীজের গুণগত মান, সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার এবং সংগ্রহ-পরবর্তী সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সমন্বিত উদ্যোগে আলুর মান উন্নয়নে এখনই বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে আলুর রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক। ভারত, নেদারল্যান্ডস, চীন ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলো বছরে বিপুল পরিমাণ আলু ও আলুভিত্তিক পণ্য রপ্তানি করে। তাই দেশের আলুর যদি মানোন্নয়নের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য করা যায়, তাহলে কৃষক লাভবান হবেন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়বে এবং দেশের কৃষি অর্থনীতি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে।

এখনই সরকারের উচিত তিনটি দিককে অগ্রাধিকার দেওয়া- প্রথমত, আলু ক্রয় কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং তা ৫০ হাজার টনের সীমা পেরিয়ে অন্তত ৫ লাখ টনে উন্নীত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোল্ডস্টোরেজ ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ প্রণোদনা; তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা ও প্রশিক্ষণ।

মনে রাখতে হবে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা শুধু মানবিক দায় নয়, এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত। আলু আবার ‘সোনার ফসল’ হতে পারে- যদি সরকার কৃষকের পাশে দাঁড়ায়, ন্যায্য দাম দেয় এবং বিশ্ববাজারে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে।