বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞান উৎপাদন জরুরি

আব্দুল কাদের জীবন
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪১
শেয়ার :
বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞান উৎপাদন জরুরি

একটি দেশের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা প্রাণবন্ত, কার্যকর এবং জ্ঞান সৃষ্টিতে নিবেদিত। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের জাতীয় জীবনে যতবারই কঠিন সময় এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রতিবার আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়িয়েছে, দেখিয়েছে সঠিক পথের দিশা।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনার মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা প্রশ্নাতীত, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকেই জন্ম নিয়েছে বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ, যা জাতিকে সঠিক পথে চালিত করেছে।

কিন্তু গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে এই বিপুল ভূমিকার পাশে যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ- জ্ঞান উৎপাদন ও গবেষণার দিকে তাকাই, তখন এক গভীর হতাশা গ্রাস করে। আফসোসের বিষয় হলো, আধুনিক এই সময়ে এসেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্রেফ ‘বিদ্যা গেলানো’ হয়, কিন্তু ‘জ্ঞান সৃষ্টি’ করা হয় না। শিক্ষার্থীরা আজও নোট মুখস্থ করে, শিট নকল করে পরীক্ষায় পাস করে এবং একটি সনদ অর্জন করে- যা কেবল তাদের নামেই একটি ডিগ্রি যোগ করে। এই মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নতুন কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার, প্রশ্ন করার বা নতুন আইডিয়া তৈরির সুযোগ দেয় না। এটি কেবলই চাকরির বাজারে প্রবেশের একটি গেটপাস তৈরি করে, কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে কোনো অবদান রাখে না।

এর ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও র?্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভঙ্গুর দশা উন্মোচিত হয়। কিছুদিন আগে ঢাবির স্নাতক সনদকে একটি ফাউন্ডেশন কোর্সের সঙ্গে তুলনা করেছে সিঙ্গাপুর। কিউএস বৈশ্বিক র?্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৫৮৪তম অবস্থান কিসের ইঙ্গিত দেয়? এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এটা স্পষ্টত দেখিয়ে দেয় যে, বৈশ্বিক জ্ঞান-মানচিত্রে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি, আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকতে পারছে না। হাতেগোনা তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা গবেষণার সুযোগ থাকলেও দেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উন্নত সুবিধা নেই। গুচ্ছ অধিভুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও নতুন জ্ঞান উৎপাদনের কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। অথচ জ্ঞান উৎপাদনের পর্যাপ্ত সম্ভাবনা, বিপুল মেধা এবং প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ আমাদের রয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ এবং পরিকল্পনার অভাবই এই দুর্দশার প্রধান কারণ।

আমরা আজও শিল্পোন্নত দেশগুলোর তৈরি করা জ্ঞান, থিওরি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলছি। কিন্তু আর কতকাল? একটি জাতি কেবল অন্যের তৈরি করা জ্ঞান আমদানি করে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না বা উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আমাদের নিজস্ব জলবায়ু সমস্যা, সামাজিক চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক জটিলতা- এগুলো সমাধানের জন্য আমাদেরই নিজস্ব জ্ঞান উৎপাদন করতে হবে, যা আমাদের দেশের মাটির সঙ্গে মানানসই হবে। এই দেশজ জ্ঞানই হতে পারে আমাদের টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি।

গবেষণার সুযোগের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রের অভাবও প্রকট। শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন আইডিয়া উৎপাদনে পারদর্শী হতে পারত, কিন্তু সেগুলোকে কদর করার, পরিচর্যা করার বা বাস্তবায়নের জন্য কোনো কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা নেই। ফলে কী হচ্ছে? হতাশাগ্রস্ত মেধাবীরা প্রতিবছর পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে- যেখানে তাদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন হবে। এটি কেবল মেধাপাচার নয়, এটি জাতীয় সম্পদের অপচয়। আমরা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মেধাবী মানবসম্পদ বিদেশের হাতে তুলে দিচ্ছি, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনর্গঠিত করতে প্রথমত, মুখস্থনির্ভরতা ত্যাগ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কেবল পাঠ্যবইয়ের তথ্য মুখস্থ করানোর পরিবর্তে তাদের মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। এর জন্য পরীক্ষা পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনে মুখস্থ জ্ঞানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর বোধগম্যতা ও বাস্তব প্রয়োগের ক্ষমতা যাচাই করা অপরিহার্য।

দ্বিতীয়ত, গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় যে জ্ঞান উৎপাদনের কেন্দ্র, এই ধারণাটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং রাষ্ট্রকে গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ বহুলাংশে বৃদ্ধি করে সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর তদারকি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, মুক্তবুদ্ধি ও উদ্ভাবনী সংস্কৃতি লালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নতুন আইডিয়া উৎপাদনে উৎসাহী করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে এবং ইনোভেশন ল্যাব, স্টার্টআপ সেন্টার ও আইডিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মুক্তচিন্তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নোট-শিট নকল করে ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং নতুন জ্ঞান উৎপাদনই হোক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রাণবন্ত গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র, যেখানে উৎপন্ন জ্ঞান দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হবে, যা আমাদের উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে এবং জ্ঞান বিতরণকারী জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে।


আব্দুল কাদের জীবন : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়