ঋণ করে ঘি খাওয়ার লোভ সংবরণ করুন

এহ্সান মাহমুদ
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৩০
শেয়ার :
ঋণ করে ঘি খাওয়ার লোভ সংবরণ করুন

প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দর্শনের একটি বাণী হচ্ছে : ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ/যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। সরল বাংলায় যার অর্থ হলো- ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। চার্বাকের এই দর্শনে পকেটে টাকা না থাকলে ধার করে ঘি খাওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এমনটা কারও কারও মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক পৃথিবীতে এই নীতি সুবিধাজনক হওয়ার উপায় দেখি না। বরং নিজের টাকায় ঘি কিনে খাওয়াই মঙ্গল হতে পারে।

আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে, ঘি হলো সুপার ফুড। নিয়মিত ঘি খেলে হজমশক্তি বাড়ে, দেহে শক্তি জোগায়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী করে, শরীর ভালো রাখে, ত্বক ভালো রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দেখা যাচ্ছে ঘিয়ের অনেক গুণ। তবে একসঙ্গে অনেকখানি ঘি খাওয়া যাবে না, এই বিষয়ে অভিজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। এক চামচ ঘি-ই যথেষ্ট।

আলোচনা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বিষয়টা ধান ভানতে গিয়ে শীবের গীত গাইবার মতো মনে হতে পারে। তাই সরাসরি বিষয়ে ঢুকে যাই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ঢাকার পল্টন এলাকায় এক কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে, আঙুল বাঁকা করব; ঘি আমাদের লাগবেই। সুতরাং যা বোঝাতে চাই, বুঝে নিন। নো হাংকি পাংকি। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট লাগবেই। ... প্রয়োজনে আবার জীবন দেব। জুলাইয়ের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে দেব না।’ (৬ নভেম্বর, ২০২৫, আমাদের সময় অনলাইন)

জামায়াতের নেতার এই বক্তব্য শুনে একটি আফ্রিকান প্রবাদের কথা মনে পড়ল। যার বাংলাটা এমন- ‘কুড়াল ভুলে যায় গাছ মনে রাখে’। আফ্রিকান এই প্রবাদের ব্যাখ্যা-ভাবার্থ হলো, যে অন্যকে কষ্ট দেয় সে ভুলে যায়; কিন্তু যে কষ্ট পায় সে মনে রাখে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অতীত যে কোনো বাংলাদেশির জন্যই ভুলে যাওয়ার নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতের যে বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান সেটা কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। কিছুদিন আগেও জামায়াতের আমির বলেছেন, জামায়াত ক্ষমা চেয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ৫৫ বছর পরও ক্ষমা না চাওয়ায় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। সবশেষ জামায়াতের বর্তমান আমির শফিকুর রহমান ১৯৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, বিনাশর্তে মাফ চেয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, এর আগেও দলটির আরও দুই নেতা ক্ষমা চেয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে- ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করার যে অভিযোগ দলটির বিরুদ্ধে আছে, সে বিষয়ে আদৌ কি গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ দলটির নেতারা কখনও ক্ষমা চেয়েছেন? নাকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর যে প্রভাবশালী অবস্থান দৃশ্যমান হচ্ছে, সে জায়গা থেকে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার চিন্তা থেকে মানুষের সহানুভূতি পেতে দলটির আমির নতুন করে ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন- এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গ এলেই আলোচনায় আসে ১৯৭১ সালে দলটির ভূমিকার কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার জন্য জামায়াতের সহায়তায় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। এসব মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের নানা দালিলিক প্রমাণ। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার, যদিও সেই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল জামায়াতের। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য এখন পর্যন্ত দলীয় বা আনুষ্ঠানিকভাবে দোষ স্বীকার করেনি তারা। পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম এজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাসের রায় হয়। এনিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা মানুষ, কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নই। দল হিসেবে দাবি করি না, আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। এ সংগঠনের প্রতিটি কর্মী, সহকর্মী কিংবা দলের দ্বারা যে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন- সবার কাছে বিনাশর্তে মাফ চাই। আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ (বিবিসি বাংলা)

২.

জামায়াত নেতা তাহেরের বক্তব্যের জবাবে চিকিৎসক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ বলেছেন, “এটা জামায়াতে ইসলামীর জন্য শুভ লক্ষণ নয়। ঘি খাওয়ার ইচ্ছে হলে কেন পুরনো রীতিতে আঙুল বাঁকিয়ে ঘি তুলে খেতে হবে? আঙুল চাটতে হবে কেন? যদি চাটার ইচ্ছে থাকে তবে তা গোপনে করুন; আর আধুনিকভাবে খেতে চাইলে চামচ ব্যবহার করে ভদ্রভাবে খান। এই ধরনের ‘চাটাচাটি’ করে ঘি খেয়ে জাতিকে নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। এসব মূলত উত্তেজক কথা।”

চব্বিশের পাঁচ আগস্টের পর দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সংবিধান পরিবর্তন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধান পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যে কোনো সংস্কারের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবিধান বাংলাদেশের সব মানুষের ত্যাগ ও একতাবদ্ধ আকাক্সক্ষার ফসল। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের জন্য এককভাবে সংবিধান পরিবর্তন করার অধিকার নেই। সংস্কারের প্রস্তাবগুলোতে অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হতে হবে এবং সমাজের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে- সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং গণতন্ত্রহীনতার জন্য শুধু সংবিধানকে দায়ী করার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। বরং সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র অনুশীলনের গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলে গণতন্ত্র কখনই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে না। সেই সঙ্গে জামায়াত নেতা যেভাবে আঙুল বাঁকা করে ঘি খাওয়ার কথা বললেন, তা আমাদের ‘সালিশ মানি তালগাছ আমার’ মনোভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষা প্রকাশের বিপরীতে দলটির মনে রাখা ভালো যে, ঋণ করে ঘি খেতে চাইলে আরও বহু হিসাব তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে।


এহ্সান মাহমুদ : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক

মতামত লেখকের নিজস্ব