সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই

সম্পাদকীয়
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৭
শেয়ার :
সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

ডেঙ্গু নিয়ে জনগণের শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছেই। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর আসছে। একসময় ডেঙ্গু শুধু রাজধানী ঢাকার সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু এখন রাজধানী ছাড়িয়ে অন্যান্য বড় শহর ও জেলা-উপজেলা শহরে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে তা প্রায় সারা বছর চলমান এক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়-২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অপর দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মাসের প্রথম ছয় দিনে ডেঙ্গুতে ২৯ জনের মৃত্যু হলো। দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত মাসে মারা গেছেন ৮০ জন, যা চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো এক মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এবং সব মিলিয়ে এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ৭৬ হাজার ২৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যেন এক মর্মান্তিক পরিসংখ্যান, যা শুধুই সংখ্যার হিসাব নয়, বরং সরকারি উদ্যোগের ব্যর্থতার এক কঠিন প্রতিচ্ছবি। এভাবে কি আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল প্রতিনিয়ত চলতেই থাকবে? প্রতিটি প্রাণহানি একটি পরিবারকে অশ্রুসিক্ত করছে, সমাজকে শোকে নিমজ্জিত করছে। প্রশ্ন উঠছে-এত প্রাণহানির পরও কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট তৎপর হয়েছে? হলে আজ ডেঙ্গুর এই ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হতো না। জুনের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন, এবারের ডেঙ্গু মৌসুম ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু সরকার, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগ যথাসময়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফগার মেশিনে কীটনাশক ছিটানো, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করা বা মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সচেতনতা বাড়ানো-কোনোটিই পরিকল্পিতভাবে করা যায়নি। ফলাফল, নাগরিকদের প্রাণহানি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ চাপ।

ঢাকা শহরেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক। দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, আর মৃত্যুও এখানেই বেশি। দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, দুর্বল মনিটরিং ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা এখন প্রকাশ্য। মশা মারার ওষুধে কার্যকারিতা নেই, তারপরও তা পরিবর্তন বা উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিছু সময় সামান্য প্রচারণা চালানো হলেও তা ছিল দায়সারা। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু অনেক হাসপাতালে প্লাটিলেট পরীক্ষা বা সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর পূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারে না। এ অবস্থায় উপজেলা-জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পূর্ণ চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-ডেঙ্গু প্রতিরোধ, রোগের বাহন এডিস মশা নির্মূল করা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সাধারণ জনগণ-সবার অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন সচতেনতা ও সমন্বিত কার্যক্রম। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে, বাড়িতে ও আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শুধু ওষুধ ছিটালেই হবে না, সেটা যেন কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই মৃত্যুর মিছিল চলতে দেওয়া আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডেঙ্গু এখন শুধুই চিকিৎসাবিষয়ক সংকট নয়; এটি নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রতিবার মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ বা সামান্য তৎপরতা যথেষ্ট নয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধ অসম্ভব কিছু নয়-কিন্তু তার জন্য চাই সরকারের সদিচ্ছা। সরকার বা রাষ্ট্রের দৃঢ়তা ছাড়া তা মোকাবিলা সম্ভব নয়। যদিও এটি সরকারের একক দায়িত্ব¡ নয়; সিটি করপোরেশন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব এজেন্সি, কমিউনিটি নেতৃত্ব, সামাজিক সংগঠনসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়ই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সেজন্য আমাদের দরকার এক দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, যাতে আগামী বছর ডেঙ্গু আর এভাবে ফিরে না আসে।