নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

শামীম মিয়া
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৮
শেয়ার :
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

শীতের আগমন শুধু মানুষের পোশাক বা প্রকৃতির আবহে পরিবর্তন আনে না, সঙ্গে নিয়ে আসে প্রকৃতির এক অপূর্ব সৌন্দর্য-অতিথি পাখিদের আগমন। তারা আসে দূর উত্তরের দেশ থেকে, হাজার হাজার মাইল উড়ে এসে, বিশ্রামের আশ্রয় খুঁজতে। এই পাখিরা আসে শান্তি ও উষ্ণতার টানে, আমাদের দেশের হাওর, বিল, নদীচর আর জলাভূমিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে। তাদের আগমন যেন প্রকৃতির এক নিঃশব্দ উৎসব, যেখানে আকাশে ভাসে স্বাধীনতার গান।

অতিথি পাখিরা পৃথিবীর নাগরিক। তারা প্রতিবছর দূর সাইবেরিয়া, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চীন, নেপাল কিংবা হিমালয়ের তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে আমাদের দেশে। সেখানে যখন বরফে ঢেকে যায় মাঠ, নদী জমে যায়, খাদ্য ফুরিয়ে আসে, তখন এই পাখিরা দলবদ্ধ হয়ে উড়ে আসে দক্ষিণে, যেখানে আছে পানি, উষ্ণতা, খাদ্য আর জীবন। বাংলাদেশের বিস্তৃত জলাভূমি, হাওর-বাঁওড়, নদীচর, সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকা তাদের জন্য স্বর্গের মতো। এখানে তারা খাবার খুঁজে পায়, বিশ্রাম নেয়, কখনও দীর্ঘ যাত্রার আগে শক্তি সঞ্চয় করে।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা আসে। এই সময়টায় দেশের নানা প্রান্তে দেখা যায় নানা রঙের, নানা আকারের পাখি। চখাচখি, সরালি হাঁস, পাতিহাঁস, বালিহাঁস, ধলাপিঠ রাজহাঁস, কালিম পাখি, বেগুনি বক, খয়রা চখাচখি, চিতল হাঁস-সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক চলমান চিত্রকল্পে রূপ নেয়। হাওরের পানিতে তাদের ভেসে থাকা, ডানার ঝাপটা, কলতান, খেলা-সবকিছুতেই লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। অতিথি পাখিদের আগমন শুধু সৌন্দর্যের নয়, এটি আমাদের পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা জলাভূমির পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশ পরিশুদ্ধ রাখে, অনেক সময় বীজ ছড়িয়ে নতুন গাছ জন্মাতে সাহায্য করে। তাদের উপস্থিতি জলাশয়ের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্রে?্যর ভারসাম্য বজায় রাখে। প্রকৃত অর্থে তারা আমাদের বন্ধু, প্রকৃতির কর্মী, যারা নীরবে আমাদের জন্য কাজ করে যায়। তাদের বিলুপ্তি মানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ সেই অতিথি পাখিরা নিরাপদ নয়। মানুষ, যে একসময় তাদের কলরবে আনন্দ পেত, সেই মানুষই এখন তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি। শীত এলেই শুরু হয় অবৈধ শিকারের মৌসুম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে হাওর ও বিলের পাশে বসবাসকারী কিছু অসাধু ব্যক্তি পাখি ধরতে বসায় ফাঁদ, জাল, কখনও বন্দুক ব্যবহার করে-তারা ধরে, মারে, বিক্রি করে। বাজারে বিক্রি হয় অতিথি হাঁসের মাংস, অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টে ‘বিশেষ পদ’ হিসেবে তা পরিবেশন হয়। অথচ তারা জানে না, এটি কেবল আইনবিরোধী নয়, এটি নৈতিকতার বিরুদ্ধেও এক ভয়ংকর অপরাধ। অতিথি পাখি হত্যার মানে হলো প্রকৃতির প্রাণকেই হত্যা করা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একসময় অতিথি পাখির সমারোহ দেখা যেত। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সুন্দরবন কিংবা নদীর চরে হাজার হাজার পাখির আনাগোনা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। এখন সেই দৃশ্য অনেক জায়গায় বিলুপ্ত। নদী ও হাওরের জল দূষিত, অনেক জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। শিকারিদের ভয়, মানুষের লোভ, আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-সব মিলিয়ে তারা এখন বিপন্ন। এই বিপন্নতার জন্য শুধু শিকারি নয়, দায় আমাদের সবার।

অতিথি পাখিদের রক্ষা করা মানে আমাদের সংস্কৃতিরও রক্ষা। এই পাখিরা আমাদের সাহিত্য, কবিতা, গান ও গল্পে জায়গা করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুকান্ত-কেউ না কেউ এই পাখিদের গান গেয়েছেন, তাদের উড়ালের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন মুক্তির প্রতীক। পাখি মানে স্বাধীনতা, প্রকৃতির মাধুর্য, জীবনের উচ্ছ্বাস। আমরা যদি তাদের নিঃশেষ করি, তাহলে নিঃশেষ হবে আমাদের সৌন্দর্যবোধও। অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে আসে অতিথি হয়ে, তাই তাদের আতিথেয়তা নিশ্চিত করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। অতিথিকে হত্যা নয়, সুরক্ষা দিতে হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে মানবতার প্রতি সম্মান জানানো। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, সেটি শুধু মানুষের নয়-গাছ, পাখি, প্রাণী, নদী-সবাই মিলে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছে। তাই একে অপরের অস্তিত্বকে সম্মান জানাতে শিখতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি-পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও অতিথি পাখি সংরক্ষণের শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে। আজ আমাদের সবার অঙ্গীকার হতে হবে-অতিথি পাখির নিরাপত্তা ও স্বাধীন চলাফেরা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা কেউ যেন তাদের শত্রু না হই, বরং হই তাদের বন্ধু।

আমরা সবাই মিলে এই অঙ্গীকার করি-আমরা অতিথি পাখি মারব না, বরং তাদের জন্য এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর, নিরাপদ ও ভালোবাসায় ভরপুর করে তুলব। যতদিন আকাশে উড়বে পাখিরা, ততদিনই বেঁচে থাকবে মানুষ, প্রকৃতি, আর পৃথিবীর শান্তি।


মো. শামীম মিয়া : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, সাঘাটা, গাইবান্ধা