প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা থাকা প্রয়োজন

কামরুজ্জামান
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫০
শেয়ার :
প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা থাকা প্রয়োজন

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচন-সমালোচনা। তবে ইতোমধ্যে যতটুকু দেখলাম তার বেশির ভাগই এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মানুষ মন্তব্য করছে। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গায় সংগীত শিক্ষা ও শিক্ষক থাকার পক্ষেই মত দিয়েছেন সবাই।

এখন আসা যাক সংগীত শিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষা শিশুদের জন্য কতটা সহায়ক ও প্রয়োজনীয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা। আমাদের দেশে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাথমিক শিক্ষা হিসাবে ধরা হয়। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের শ্রেণি কার্যক্রমে পাঠ ও শিখন পদ্ধতি অত্যন্ত কঠিন এবং ধৈর্যশালী কাজ। আমরা সাধারণভাবে দেখি একটি শিশুকে ৪০ মিনিট বা ১ ঘণ্টার একটি ক্লাসে শুধু নিরানন্দ পড়ালেখা দিয়ে মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে শিখন পদ্ধতির কিছু রুলস ফলো করা হয়। এর মধ্যে শিশুদের গান শোনানো, গান গাওয়া, কবিতা-ছড়া বলা-বলানো এবং কিছু কলাকৌশল অবলম্বন করে সম্মিলিত কোরাস গান বা হাততালি দেওয়ার সুযোগের মাধ্যমে পাঠে মনোযোগ বাড়ানো হয়। এর বাইরেও স্ব স্ব শিক্ষক শিশুদের মনোযোগ বাড়ানোর জন্য নিজস্ব টেকনিক অবলম্বন করে ক্লাসটি আনন্দঘন পরিবেশে শেষ করার চেষ্টা করেন। এর সঙ্গে শিশুদের জন্য থাকে নানারকমের শিক্ষা উপকরণ। ফলে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে তাদের বিদ্যালয়ের পড়াগুলো আয়ত্ত করে। এবং পরের দিন স্কুলে আসার আগ্রহ তৈরি করে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমাদের দেশে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা আশঙ্কাজনক। ক্লাসে শিশুদের পড়ালেখা তৈরি এবং বিদ্যালয়ে নিয়মিত হওয়ার মূল আকর্ষণ হিসেবে কাজই করে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস। এ ক্ষেত্রে সংগীত এবং শরীরচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও একটি বিষয় বর্তমান সময়ে মোবাইল আসক্তি ও অনলাইন অ্যাক্টিভিটি শিশুদের প্রতিনিয়ত পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের পড়ালেখায় মনোযোগ বাড়াতে এবং মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না।সংগীতচর্চা এবং শারীরিক শিক্ষা শিশুর মেধাকে বিকশিত করে এবং মেধার স্তরকে শানিত করে এটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত।

পৃথিবীর বিখ্যাত মনীষী, বিজ্ঞানী, গবেষকদের জীবনী পড়লেও দেখা যায়, তারা সংগীত ভালোবাসতেন, বিভিন্ন সংগীত যন্ত্র নিজেরাই বাজাতেন। অবসরে গান করতেন এবং গান শুনতেন। এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন স্যারের একটি লেখার কিছু অংশ তুলে ধরা হলোÑ

‘আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন মন শান্ত করার জন্য, আর গভীরভাবে চিন্তা করতে। প্ল্যাঙ্ক, যিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক, তিনি ছিলেন দক্ষ পিয়ানোবাদক। রিচার্ড ফাইনম্যান বংগো বাজাতে ভালোবাসতেন, আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু এসরাজ বাজাতেন এবং একই সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ভীষণ অনুরাগী। তারা কেউই সংগীতকে শখ হিসেবে দেখেননি-এটি ছিল তাদের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গী ও জ্ঞানতৃষ্ণার অনুঘটক। সংগীত মনকে সমৃদ্ধ করে, আত্মাকে প্রশান্তি দেয় এবং চিন্তার এমন নতুন দিগন্ত খুলে দেয় যা শব্দ কিংবা সূত্র দিয়ে পুরোপুরি ধরা যায় না। এটি আমাদের শেখায় মনোযোগ দিয়ে শোনা, কল্পনা করা এবং গভীরভাবে অনুভব করতে-যে গুণগুলো শুধু একজন বিজ্ঞানী নয়, প্রতিটি মানুষেরই প্রয়োজন। এটি শৃঙ্খলা শেখায়, দলগত কাজের অভ্যাস গড়ে তোলে এবং অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোকে প্রকাশের ভাষা দেয়। স্কুলের কোরাস বা ব্যান্ড শুধু বাদ্যযন্ত্রের মহড়া নয়, এটি হয়ে ওঠে কমিউনিটি, আত্মবিশ্বাস আর স্বকণ্ঠ খুঁজে পাওয়ার জায়গা।’

শিক্ষা সর্বজনীন ও সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার পরিবেশ হওয়া প্রয়োজন চিত্তাকর্ষক ও যুগোপযোগী। আর এ কারণেই প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা থাকা জরুরি।


ড. কামরুজ্জামান : গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর

মতামত লেখকের নিজস্ব