পোশাকের রাজনীতি: সংস্কৃতি ও ধর্ম রক্ষার দায় একা নারীর?

ফেরদৌস আরা রুমী
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪২
শেয়ার :
পোশাকের রাজনীতি: সংস্কৃতি ও ধর্ম রক্ষার দায় একা নারীর?

মানবসভ্যতার শুরুতে পোশাক নারীর শালীনতা, ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতার প্রতীক আকারে হাজির ছিল না। পুরুষ ও নারী উভয়েই তুলনামূলকভাবে সরল পোশাক পরত। তখন পোশাক ছিল ঢিলেঢালা, কাপড় পেঁচিয়ে তৈরি-কোনো সেলাই করা জামা ছিল না। এরপর বিভিন্ন যুগে এসে রাষ্ট্র ও ধর্ম সংগঠিত হতে শুরু করে এবং পোশাকেও শৃঙ্খলার ধারণা আসে। নারীর পোশাকে বিলাসিতা ও শ্রেণিবিভাজন দেখা দেয়। রাজপরিবারের নারীরা সূক্ষ্ম সুতির ও রেশমি কাপড়, অন্যদিকে সাধারণ নারীরা মোটা তুলা বা উলের তৈরি পোশাক পরতে শুরু করে। পাশাপাশি পোশাকে ধর্মীয় শুদ্ধতা ও সামাজিক মর্যাদার ধারণা উঠে আসে এবং যা শুধু নারীকে বহন করে যেতে হয় এবং হচ্ছে।

বৈদিক যুগে পোশাক যেখানে ছিল প্রকৃতিনির্ভর ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পরিধানের জন্য, সেখানে কালের বিবর্তনে এটির অর্থ বদলে নারীর শালীনতা ও লজ্জা ঢাকার বস্তু হয়ে ওঠে কেবল। গুপ্ত যুগ থেকে শাড়ি হয়ে ওঠে নারীর নৈতিকতার প্রতীক, দেবী দুর্গা বা লক্ষ্মীর শাড়ি পরিহিতা রূপ সেই ধারণাকেই দৃঢ় করে। মুসলিম শাসনামলে আবরণ ও পর্দার সংস্কৃতি শাড়িতে যোগ করে নতুন মাত্রা-ঘোমটা হয়ে ওঠে লজ্জাশীলতার চিহ্ন। ঔপনিবেশিক যুগে আবার শাড়ি নতুন পরিচয় পায় দেশীয় ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে। পোশাক যে একসময় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষ উভয়েই অনেকটা একই রকমভাবে পরিধান করত, সেই ধারণাটা হারিয়ে যায়। উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজে বাঙালি নারী মানে শাড়িতেই মানানসই এবং শাড়ি না পরলে বাঙালি নারীকে চেনা যায় না-এসব বয়ানের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাঙালি মুসলিম নারী হলে মাথায় কাপড়, হিজাব বা বোরকা পরিধান বাধ্যতামূলক বলে ধর্মচর্চা এবং সংস্কৃতি রক্ষার দায় হিসেবে চেপে বসে। কিন্তু ধর্ম, আচার কিংবা সংস্কৃতি রক্ষার দায় পুরুষেরও আছে এবং মানা বাধ্যতামূলক-এসব বয়ান আকারে হাজির হয় না। পুরুষের ধর্ম বা সংস্কৃতি রক্ষার নামে কোনো পোশাক নির্দষ্ট করাও নেই অথবা থাকলেও তা চাপিয়ে দেওয়া আকারে নেই। সে দিব্যি পশ্চিমা পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে পারে। অন্তত পুরুষকে ধর্মীয় বা সংস্কৃতি-আচার-ব্যবহার মেনে পোশাক পরিধান না করার কারণে বাসে-ট্রেনে নির্যাতনের শিকার হতে হয় না।

ওপরের আলাপের সূচনা করার কারণ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা, যেখানে তিনজন ভিন্ন ভিন্ন নারী শুধু পোশাকের কারণে অপদস্থ, নির্যাতন এবং কটূক্তির শিকার হয়েছেন। রাজধানীর বছিলার বাসে এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী পোশাকের কারণে কটু মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে একজন বাস কন্ডাক্টর একাধিকবার তাকে কটূক্তি করে চড়-ধাক্কা দেন, যেখানে অন্য যাত্রীরা কন্ডাক্টরকে না থামিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনরোষ তৈরি হয় এবং র‌্যাব-৪ অভিযুক্ত কন্ডাক্টর নিজাম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করে। ভুক্তভোগী তরুণী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (সংশোধিত) ১০ ধারায় মামলা করেন, যা যৌন নিপীড়নমূলক অভিযোগের জন্য প্রযোজ্য। এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তরুণী বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ঘটনাটি গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা ও যাত্রীদের নীরবতার সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। আরেকটি ঘটনায় দেখা গেছে, কয়েকজন তরুণ একজন নারীকে ওড়না কোথায় বলে হেনস্তা করছে এবং সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ হেনস্তাকারীকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একই ক্যাম্পাসের ছাত্রীকে লেংটা মেয়ে বলে সম্বোধন করছেন পোশাকের শালীনতার দোহাই দিয়ে, যেখানে ছাত্রীটি তার সহপাঠীর খুনের বিচার চেয়ে আন্দোলন করছিলেন। সেই মন্তব্যের অডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার মুখে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েই পার পেয়ে যান ওই শিক্ষক।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা সহিংসতা, নির্যাতন কিংবা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন ঘটনা জানা যায়। ২০২২ সালে ইউএনডিপি পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, প্রায় ৮৭% নারী জীবনে অন্তত একবার যেকোনো ধরনের হেনস্তার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে গণপরিবহন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আঁচল ফাউন্ডেশনের আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকায় ৬৩.৪% তরুণী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন; হয়রানির ধরনের মধ্যে কারও পোশাক নিয়ে মন্তব্য, কারও শরীরে অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ, কারও গায়ে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা ইত্যাদি। অন্য এক গবেষণা বলছে, হয়রানির শিকার নারীদের মাত্র ২% আইনি পদক্ষেপ নেন। বাকি ৯৮% নারী চুপ থাকেন-হয় ভয়ে, নয় সামাজিক কলঙ্কের আশঙ্কায়।

নারীর ওপর ঘটা হয়রানি/নির্যাতনের মধ্যে পোশাকই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বেশি। যেন নারীর পোশাকই তার প্রতি সহিংসতার কারণ! এমন যুক্তি শুধু হাস্যকর নয়, এটি গভীরভাবে ক্ষতিকরও। কারণ এতে সমাজের দৃষ্টি মূল অপরাধ থেকে সরে যায় এবং নারীদেহ নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি আরও শক্ত হয়। বাংলাদেশে নারীরা শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতি ও অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী দেশের উন্নয়নে সমান অবদান রাখলেও সমাজে এখনও নারীর মূল্যায়ন প্রায়ই পোশাকের শালীনতা, আচার, সংস্কৃতি রক্ষার পারদর্শিতার ওপর নির্ভর করছে।

অর্থাৎ নারীর জীবন-চলাচল এখন শুধুই ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অংশ। পোশাক নিয়ে হেনস্তার ঘটনার পেছনে সেই নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো কাজ করছে বলে তাকে শুনতে হয়-এই পোশাকের কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একটি ঘটনাও পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটে না বা নেই, কারণ পিতৃতন্ত্রের হাতে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা বহাল আছে। পুরুষ তো বটেই, কখনও কখনও নারীও পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক হয়ে সেই কাজটি এগিয়ে নেয়।

একইভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও দ্বৈত মানদণ্ড স্পষ্ট। একজন মুসলিম নারী যদি হিজাব না পরেন বা পর্দা না করেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে-‘তিনি কি ইসলামিক?’ অথচ সেই ধর্মেরই পুরুষ যখন শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ান, তার ধর্মীয় আচার, চর্চা, সংস্কৃতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই সুবিধাবাদী কাঠামোই তৈরি করেছে, যেখানে নারীকে (শালীনতার দোহাই দিয়ে) নিয়ন্ত্রণ মানে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা করা। কারণ তারা নারীর সক্রিয়তা, অংশগ্রহণ, অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ মনে করে এবং খবরদারির জায়গাটি কমে যাবে বলে নানা অজুহাত তৈরি করে।

তবে এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নারীকে আরও অনিরাপদ করে তোলা হয়। নারীর নিরাপত্তা একটি সমষ্টিগত বিষয়, কোনো নির্দষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট ধরনের পোশাক বা আচরণের ওপর নির্ভর করে না। যখন আমরা বলি-‘অমুক গোষ্ঠীর নারীরা নিরাপদ, কারণ তারা সঠিক পোশাক পরিধান করে,’ তখন আমরা আসলে অন্য গোষ্ঠীর নারীদের অনিরাপত্তাকে বৈধতা দিই। নিরাপত্তা যদি সামগ্রিক না হয়, তবে সেটি নিরাপত্তা নয়; বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এক বয়ান, যা নারীর স্বাধীনতার জায়গাটিকে সংকুচিত করে ফেলে।

সবশেষে প্রশ্ন থেকে যায়-এই দায় কেন কেবল নারীর? ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি কি পুরুষের নয়? নারীর পোশাক রক্ষার চেয়ে পুরুষের আচরণ সংস্কারের দাবি কি কম গুরুত্বপূর্ণ?

যে সমাজে নারীকে রক্ষা করার অজুহাতে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, সে সমাজ নিরাপদ হতে পারে না। ধর্ম কিংবা সংস্কৃতির প্রকৃত মূল্যবোধ নারীকে আড়াল করা নয়, তাকে মর্যাদা দেওয়া। নারীদেহ কোনো সংস্কৃতি বা ধর্মের রক্ষাকবচ নয়; এটি একটি স্বাধীন জীবনের অধিকারী শরীর। যতদিন নারীদেহে ধর্ম-সংস্কৃতির দায় চাপিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, ততদিন এই সমাজ প্রকৃত অর্থে সভ্য হতে পারবে না।


ফেরদৌস আরা রুমী : লেখক ও অধিকারকর্মী

মতামত লেখকের নিজস্ব