রাজনৈতিক তাৎপর্য

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:২৯
শেয়ার :
রাজনৈতিক তাৎপর্য


বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক অবিস্মরণীয় নামÑ যুগ যুগ ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ দেশের গণমানুষ জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধাভরে। এর যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। বাংলাদেশ যখনই কোনো সংকটে পড়েছে, সেই সংকট থেকে উত্তরণের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। নিজের ও নিজের পরিবারের জীবন বিপন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেখানে ব্যর্থ, জিয়াউর রহমান সেখানে সফলÑ তার দেশপ্রেম এবং গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে।

একটি রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ যেরকমভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল তার কিছুই হয়নি বরং দুর্ভিক্ষ ও অপশাসনে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশ একটি অস্থির সময় অতিবাহিত করছিল। সামরিক বাহিনীতে তখনও আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু সেনা অফিসার সব কার্যক্রমে নানান ধরনের বিপত্তির চেষ্টা করছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন সেনাপ্রধান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান সেনবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার মোশাররফ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার বাসায় গৃহবন্দি করেন। তিনি একটা দাবিনামা তৈরি করেন। দাবিগুলো এ রকম :

১. ট্যাংক ও কামান বঙ্গভবন ও শহর থেকে সেনানিবাসে পাঠাতে হবে।

২. জিয়া এখন থেকে আর চিফ অব স্টাফ নন।

৩. বঙ্গভবন থেকে ফারুক-রশীদসহ অন্য কর্মকর্তাদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনে চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধার করতে হবে। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি থেকে যাবেন।

ব্রিগেডিয়ার রউফ আরেকটি দাবিনামা সংযোজন করেন, খালেদ মোশাররফকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ঘোষণা করতে হবে।

এই দাবিনামা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, তাদের প্রধান টার্গেট ছিলেন জিয়াউর রহমান।

৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মোশতাক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেন। ওই রাতে খন্দকার মোশতাক পদত্যাগ করেন।

এই ধরনের ঘটনার পরম্পরা এখানে উল্লেখের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেই সময়টা কতটা অস্থির ছিল এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো লোকের কত অভাব ছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আওয়ামী ঘরানার এবং ভারতপন্থি ছিলেন এ রকম একটা প্রচার ছিল। এর কিছুটা সত্যতাও পাওয়া যায়Ñ ৪ নভেম্বর সকালে খালেদ মোশাররফের মা ও তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের ব্যানারে মিছিল করে।

ব্রিগেডিয়ার মোশাররফ, শাফায়াত জামিল, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এটিএম হায়দারÑ এদের কর্মকাণ্ড সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করে। সৈনিকরা এ অবস্থান থেকে পরিত্রাণের জন্য নিজেরা সংগঠিত হতে থাকে। অন্যদিকে আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন বিশেষ করে জাসদেরও একটি তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া খালেদ মোশাররফ নিহত হন ৭ নভেম্বর।

৭ নভেম্বর সকালে সিপাহি-জনতা স্লোগান দিচ্ছিল -

‘সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ/জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।’ সাধরাণ সৈনিক এবং জনমানুষের মাঝে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটা ক্লিন ইমেজ ছিল। তাছাড়া স্বাধীনতার ঘোষক, সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান হওয়ার কারণে সামরিক বাহিনীতেও তার আলাদা একটি অবস্থান তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন এই অস্থির অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাই জিয়াউর রহমানকেই একমাত্র আস্থার মানুষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ২ ফিল্ড আর্টিলারিতে আসেন। জিয়াউর রহমান দেশবাসীর উদ্দেশে একটি রেকর্ডেড বেতার বার্তা দেন।

প্রিয় দেশবাসী,

আসসালামু আলাইকুম।

আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাআল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও কলকারখানাগুলো পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সবার সহায় হোন।

খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।


এর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ঐক্যের বার্তা দিলেন। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমান যেমন গণমানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ৭ নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির মূল ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।

৭ নভেম্বর সফল হয়েছিল কারণ এটা ছিল সাধারণ সৈনিক ও গণমানুষের বিপ্লব। আর ৩ নভেম্বর ছিল গুটিকয়েক উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যের রাজনৈতিক অভিলাষ। ৭ নভেম্বরে জনতার দেওয়া সম্মান পরবর্তী জীবনে তিনি সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিপালন করেছেন। যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন তখন ১৯ দফা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৯ দফার অনেক দফা এখনকার বাস্তবতায় সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে খাল খনন কর্মসূচিÑ যা কৃষিতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। জিয়াউর রহমান একাধারে ২০ থেকে ৩০ মাইল হাঁটতেন। প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে হাত মেলাতেনÑ যা মানুষকে রোমাঞ্চিত করত। জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্রনীতিতে সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়েন। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ পান। ইরাক-ইরান যুদ্ধে আরবিটার হিসেবে কাজ করেন।

৭ নভেম্বর মুক্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশকে অভিনব উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মনোনিবেশ করেন। ৭ নভেম্বর হয়েছিল বলেই আমরা নতুন করে জিয়াউর রহমানকে গণমানুষের মাঝে পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো অগ্রগতি ও সম্ভাবনাÑ তার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল দেশ গড়ার দিকে। তাই ৭ নভেম্বরের বিপ্লব আজকের বাংলাদেশে এখনও প্রাসঙ্গিক। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সাধারণ সৈনিক, জনতা জিয়াউর রহমানকে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার জন্য। তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। আজকের বাংলাদেশেও ২০২৫ সালের ৭ নভেম্বর গণমানুষ তাকিয়ে আছে বিএনপির দিকে। একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য, স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য, উন্নত বাংলাদেশের জন্য গণমানুষের একমাত্র বিশ্বস্ত ও আস্থার জায়গা বিএনপি, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ। ম



তথ্যসূত্র

বিএনপি সময়-অসময় : মহিউদ্দিন আহমদ

রক্তাক্ত দিনগুলি : এম সাখাওয়াত হোসেন