প্রয়োজন নীতিসহায়তা
পোশাক খাত
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র তৈরি পোশাক খাত। দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত এই খাতে, যার সিংহভাগই নারী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক সংকটে পড়ে এই খাত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি কমছে, অর্ডার বাতিল হচ্ছে, কারখানা বন্ধ হচ্ছে- সব মিলিয়ে শিল্পটি যেন টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আর এই অস্থিরতার ছায়া পড়ছে পুরো জাতীয় অর্থনীতিতেই।
প্রথম আঘাত এসেছে বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে চীন ইউরোপীয় বাজারে দখল বাড়ানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন দাম কমাতে চাপ দিচ্ছেন, অথচ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণগতিতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অনেক ক্রেতা আগাম সতর্ক হয়ে অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে তিন মাস ধরে টানা রপ্তানি কমেছে। জুলাইয়ে যেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ৩৯৬ কোটি ডলার, সেখানে অক্টোবরে নেমে এসেছে ৩০২ কোটি ডলারে- এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮ শতাংশ পতন। এই প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তাহলে অর্থবছরের শেষার্ধে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সংকটের আরও গভীরে আছে শিল্পের অবকাঠামোগত ও আর্থিক অস্থিরতা। সম্প্রতি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতকোটি টাকার কাঁচামাল ও পণ্য পুড়ে গেছে। এতে প্রায় ২৫০টি কারখানার রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হওয়াটা তাই অস্বাভাবিক নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য। বিভিন্ন ব্যাংক এখন রপ্তানিকারকদের এলসি খুলতে পারছে না, এমনকি শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের টাকাও আটকে যাচ্ছে। এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএলসহ কয়েকটি ব্যাংক কার্যত অচল অবস্থায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মূলত বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া এখন উৎপাদন খাতে পড়ছে। মুদ্রানীতির কঠোরতা, ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ- সব মিলে রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রাণশক্তি ক্ষয় হচ্ছে। এ ছাড়া গত এক বছরে অন্তত ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, কর্মহীন হয়েছেন ১ লাখের বেশি শ্রমিক। যদিও নতুন ১৬৬টি কারখানা চালু হয়েছে, তবুও সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের মালিকরা ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একের পর এক ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।
এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তার প্রভাব পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায়, এমনকি সামাজিক স্থিতিশীলতায়ও। কারণ তৈরি পোশাক খাত শুধু রপ্তানির উৎস নয়, গ্রামীণ নারীশক্তির আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম বড় ক্ষেত্র। লাখো নারী শ্রমিকের আয় বন্ধ হয়ে গেলে পারিবারিক ও সামাজিক টানাপড়েন বেড়ে যাবে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতি মন্থর করবে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এখন জরুরি তিনটি পদক্ষেপ। প্রথমত, নীতিসহায়তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংককে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বিশেষ ডলার উইন্ডো চালু করতে হবে, যাতে এলসি খোলা ও আমদানিকৃত কাঁচামাল সরবরাহে বাধা না থাকে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতের অরাজকতা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা। লিকুইডিটি সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোতে সরকারের বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন ব্যবস্থা দরকার, যাতে বেতন ও উৎপাদন খরচে ব্যাঘাত না ঘটে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তৃতীয়ত, অবকাঠামো ও সাপ্লাই চেইন সুরক্ষায় জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ভবিষ্যতে এড়াতে নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন অপরিহার্য। পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাও এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আস্থা ফিরে পান।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি দেশের রপ্তানি অর্থনীতির ভিত্তি, কর্মসংস্থানের কেন্দ্র ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীক। তাই এই শিল্পের পতন মানে জাতির অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় আঘাত। এখনই সময়- সরকার, মালিক ও শ্রমিক একসঙ্গে বসে বাস্তবসম্মত সমাধান বের করার। সময় নষ্ট করলে শুধু অর্ডার হারাব না, হারাব আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তিও।