অপরাধ না সংস্কৃতি

ওম্মে হাবিবা তৃষা
০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮
শেয়ার :
অপরাধ না সংস্কৃতি

দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়া এক ভয়াবহ ব্যাধি। রাষ্ট্রের উন্নয়ন, নাগরিকের ন্যায়বিচার, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যÑ কোনো ক্ষেত্রই দুর্নীতির ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ফলে মানুষের ন্যায়নীতি বিলুপ্ত হচ্ছে আর রাষ্ট্রীয় অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিদিন। যখন আমরা ‘দুর্নীতি’ শব্দটি উচ্চারণ করি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্ষমতার কড়িকাঠে বসা মানুষের ছবি, যেখানে ন্যায়বিচার টাকার ওজনেই মাপা হয়। কিন্তু এখানেই শেষ হয় না; দুর্নীতি কি শুধুই আইনের চোখে লঙ্ঘন, নাকি এটি আমাদের সমাজের অদৃশ্য সংস্কৃতি ও অভ্যাসেও রূপ নিয়েছে?

ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মোগল আমল থেকে ঔপনিবেশিক শাসন-শক্তির সঙ্গে সুবিধা গ্রহণ ও অনৈতিক সহযোগিতার প্রলোভন সব সময়ই ছিল এই অঞ্চলে। স্বাধীনতা পেয়েও রাষ্ট্রকাঠামো বদলেছে, কিন্তু মানুষের মননে যে বদলটি প্রয়োজন ছিল, তা নিশ্চিতভাবে সর্বত্র ঘটেনি। ক্ষমতার সিঁড়ি যত উঁচু হয়েছে, অনৈতিক সুবিধার পথ তত জটিল হয়ে উঠেছে। একশ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের ছাপ আজও আমাদের আচরণে, সিদ্ধান্তে ও প্রতিষ্ঠানচর্চায় প্রতিধ্বনিত হয় এটাইÑ দুর্নীতিকে কেবল কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া হিসেবে বোঝায়।

দুর্নীতি বড় আর ছোটÑ দুটিরই প্রশ্ন আছে। আমরা ঘুষকে অপরাধ বলি, কিন্তু অনেক সময়ই ‘পরিচয় আছে’ কিংবা ‘কিছুটা দিয়ে ফেলে চল’ এ ধরনের মনোভাবকে বুদ্ধিমত্তা অথবা নরম ব্যবস্থাপনা মনে করে নিই। নিয়মকে ‘বোকাদের জন্য’ ভাবা, অফিসের ফাইল এগানোর জন্য ‘কিছু দেওয়া’Ñ এসব কুশলতা যখন প্রতিদিনের অংশ হয়ে যায়, তখন দুর্নীতি কেবল আইন ভঙ্গ নয়, এটা মূল্যবোধের অবক্ষয়। স্কুলে ভর্তির সারি থেকে সরকারি টেন্ডার, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে চাকরির তালিকাÑ প্রতিটি স্তরে শর্টকাট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে দুর্নীতি এক ধরনের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে।

দায় কারÑ ব্যক্তির নাকি সমাজের? দুর্নীতিবাজ মানুষ সাধারণত জন্মগত হয় না; সে তৈরি হয় পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক প্রশ্রয়, প্রয়োজনের চাপ এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের মিলিত প্রভাবে। যেখানে ন্যায়ের প্রয়োগ দুর্বল, সেখানে অনৈতিকতা প্রশ্রয় পায়; আর যখন ন্যায়বিচার ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ায়, তখন নীতিনৈতিকতা দুর্বল হয়ে পড়ে। সমাজ যদি অপরাধকে নিন্দা না করে প্রশংসা করেÑ অর্থাৎ ক্ষমতাবান অপরাধীকে সম্মান দেয়, সৎ মানুষকে অবহেলা করেÑ তখন দুর্নীতি কেবল অপরাধ থেকে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। শর্টকাটকে সফলতার মানদণ্ড মনে করলে আইনও অসহায় হয়ে পড়ে এবং সততার মূল্য আরও ক্ষীণ হয়ে ওঠে।

দুর্নীতির ক্ষত শুধু অর্থনীতির ক্ষতি নয়; এটি মানসিকতায়ও ব্যাপক ক্ষয় সৃষ্টি করে। যোগ্য মানুষ সুযোগ হারায়, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, তরুণ প্রজন্ম হতাশায় ভোগে এবং প্রতিষ্ঠানে ও আইনের প্রতি আস্থা কমে। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপারটি হলোÑ মানুষের মনে একটা ধারণা গড়ে ওঠে যে ‘সৎ থাকলে পিছিয়ে পড়ো।’ এই ধারণা যদি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা ও মূল্যবোধই নষ্ট হতে পারে। নৈতিকতা হারালে উন্নতি যে অসম্ভব, তা ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। সমাধানের পথ কি কেবল আইনি? আইন অবশ্যই দরকার, কিন্তু প্রকৃত বিজয় নীতির জয় ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে। শিক্ষায় মূল্যবোধের পুনরায় প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কঠোর জবাবদিহি, সততার সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি, আইনের সমান প্রয়োগ এবং তরুণদের নেতৃত্বে স্বচ্ছতার চর্চাÑ এসবই সমাধানের মূল উপাদান। পরিবর্তন আসবে ভেতর থেকেÑ চিন্তা, আচরণ ও সংস্কৃতি বদলাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চরিত্র গঠনকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রম, পরিবারের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং সম্প্রদায় স্তরে সততাকে উৎসাহিত করা হলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যাবে।

সমাজ যখন অপরাধকে সহ্য করতে শুরু করে, তখন ভুল কেবল আইন ভাঙার নয়Ñ চরিত্রহীনতারও। অপরাধ যখন সামাজিক প্রশ্রয় পায়, সেটাই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। তাই নতুন প্রজন্মের দায় হলো শর্টকাট নয়, ন্যায়ের পথকে বেছে নেওয়াÑ কারণ ইতিহাস বলে, নৈতিকতা হারানো জাতি উন্নত হতে পারে না। আইন দুর্নীতিকে শাস্তি দেবে; সংস্কৃতি দুর্নীতিকে জন্ম দেয়; পরিবর্তনের শুরু তাই সচেতনতা ও বিবেকের আদালত থেকেই। তাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজই পারে প্রকৃত উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও মানবিক রাষ্ট্র গড়তে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কেবল আইনের নয়, এটি এক নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। প্রতিটি নাগরিকের ভেতর থেকে যদি সৎ চেতনা জাগ্রত হয়, তবেই পরিবর্তন সম্ভব। এখনই সময়, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ‘না’ বলি দুর্নীতিকে।


ওম্মে হাবিবা তৃষা : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়