প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাবুডাইং গ্রামে কোল জনগোষ্ঠীর পাঁচ পরিবারের উচ্ছেদ ঘটনা রাষ্ট্র ও সমাজের মানবিক চেতনার প্রতি গভীর প্রশ্ন তুলেছে। আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু আদালতের রায় বাস্তবায়নের পরও এই পরিবারগুলোর মানবিক অধিকার ও ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। প্রশাসন বলছেÑ খাসজমিতে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে, কিন্তু উপযুক্ত জায়গা না পাওয়ায় পরিবারগুলো বাঁশঝাড়ের নিচে আশ্রয়হীন অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে তাদের খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হয়েছে, শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট বেড়েছে।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সাতক্ষীরায় সাঁওতাল পরিবার উচ্ছেদ, মধুপুরে গারোদের বনভূমি থেকে বিতাড়ন, দিনাজপুরে পাহাড়িয়া ও ওরাঁও জনগোষ্ঠীর জমি দখলÑ সব ক্ষেত্রেই একই চিত্র দেখা গেছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন ও আদালতের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামাজিক বৈষম্য এই জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনে একের পর এক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মধুপুরে গারোদের বন থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনায় যেমন রাষ্ট্র বনজসম্পদ রক্ষার যুক্তি দেখিয়েছিল, তেমনি রাজশাহীতেও ‘দলিল অনুযায়ী মালিকানা’ নামের আইনগত জটিলতা দেখিয়ে মানবিক দায়বদ্ধতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের উন্নয়ন বা আইন যদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে নিরাপত্তা ও মর্যাদা না আনে, তবে সেই উন্নয়নের ন্যায্যতা কোথায়?
কোল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন আদিবাসী সম্প্রদায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা ভূমিহীন, প্রান্তিক, আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং সামাজিকভাবে বঞ্চিত। এই সম্প্রদায়ের মানুষ ভূমির অধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। বাবুডাইং গ্রামে যেসব পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে, তারা ২৫ বছর ধরে যে জমিতে বসবাস করছিল, সেটিকে খাসজমি মনে করেই ঘরবাড়ি গড়েছিল।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও প্রশাসনিক দায়িত্বÑ এই তিনটি ক্ষেত্রেই ঘটনাটি এক ধরনের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়। পাঁচটি পরিবারকে আশ্রয়হীন করে রেখে ‘খাসজমি খুঁজছি’Ñ এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য?
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের বক্তব্যে আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন উঠে এসেছেÑ যে দলিলের ভিত্তিতে জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করা হয়েছে, সেটির বৈধতা নিয়েই বিতর্ক আছে। এই ঘটনাটি বৃহত্তর একটি সংকটের প্রতীকÑ বাংলাদেশে ভূমিহীন ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমির অধিকার এখনও অনিরাপদ। নানা আইনি জটিলতা, প্রভাবশালী মহলের দখলদারি ও প্রশাসনিক অবহেলায় তারা বারবার উচ্ছেদ হচ্ছে। অথচ সরকার প্রতিবছর ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের নানা প্রকল্প চালু করে, ‘গুচ্ছগ্রাম’, ‘আশ্রয়ণ’ বা ‘ভূমিহীন পুনর্বাসন প্রকল্প’-এর কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত নীতি নিতে হবে। সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ভূমি ছাড়া সংস্কৃতি টিকে না। তাই এই সম্প্রদায়কে কেবল সহানুভূতি নয়, ন্যায়বিচার দিতে হবে।
আদালতের রায় কার্যকর করার সময় মানবিক দায়িত্ব পালনের কোনো বিকল্প নেই। এই পাঁচটি কোল পরিবারের দুঃসহ বাস্তবতা আমাদের স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দিচ্ছেÑ উন্নয়নের প্রকৃত মানে পরিসংখ্যানে নয়, মানুষের মর্যাদায়। সমাজের প্রান্তিকতম মানুষটি যখন নিরাপদ আশ্রয়, ন্যায্য অধিকার ও সম্মানের জীবন পাবে, তখনই সেই উন্নয়ন হবে সত্যিকার অর্থে মানবিক। এখনই সময়, রাষ্ট্র কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে সেই দায়িত্বের প্রমাণ দিক।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২